শ্লীলতাহানির মামলায় তাঁকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে এক মহিলার চিঠি এসেছিল তিন মাস আগে। তখন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে এক মহিলা ইন্টার্নকে যৌন হেনস্থার অভিযোগকে ঘিরে জলঘোলা হওয়ার পরে ওই চিঠি সম্পর্কে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিলেন রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর ভবানী ভবনে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের অফিসে ডাক মারফত ওই হুমকি চিঠি এসে পৌঁছয় বলে বুধবার অশোকবাবু জানান। কমিশন সূত্রে বলা হচ্ছে, চিঠিতে প্রেরক হিসেবে নাম রয়েছে বর্ধমান সদর আদালতের মুহুরি অসীমা মালিকের। ওই সূত্রেই দাবি করা হচ্ছে, কমিশনের চেয়ারম্যানের উদ্দেশে হাতে লেখা চিঠিটির বয়ান এই রকম ‘প্রথমেই বলি, আপনি কি সিপিএমের দালাল? সিপিএম থেকে কত টাকা মাসিক ভাতা পান? আপনি এক জন অকৃতজ্ঞ এবং বেইমান। মমতাদি আপনাকে সম্মান জানালেন, এবং আপনি তাঁকে অপদস্থ করছেন! খুব সাবধান। আমি আপনার বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির মামলা করব। বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।’
কিন্তু এ দিন রাতে বর্ধমান সদর কোর্টের মুহুরি অসীমা মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “আমি এমন কোনও চিঠি লিখিনি। অন্য কোনও অসীমা মালিক লিখে থাকতে পারেন।”
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে মহিলা ইন্টার্নের অভিযোগ ষড়যন্ত্রের অঙ্গ হতে পারে বলে আগেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল আইনজীবী মহলের একটা অংশ। এই হুমকি চিঠি প্রকাশ্যে আসাটা সেই তত্ত্বকেই জোরদার করল বলে তাদের দাবি। কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী মিলন মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় ষড়যন্ত্রের শিকার। তাঁর পাকিস্তান সফর নিয়ে বিতর্ক ওঠা ইস্তক রাজ্য সরকার তাঁকে অপদস্থ করার চেষ্টা করছে। ওই ক্ষেত্রে কিছু করতে না-পেরে এখন ইন্টার্নের চিঠি নিয়ে তারা ওঁকে সরাতে উঠে-পড়ে লেগেছে। বর্ধমান কোর্টের মুহুরির চিঠিটিও সেই ষড়যন্ত্রের অঙ্গ।”
এ দিন হাইকোর্টের মধ্যাহ্নবিরতিতে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের সমর্থনে আইনজীবীদের একাংশ মৌনী মিছিল করেন, যার পুরোভাগে ছিলেন মিলন মুখোপাধ্যায়, অরুণাভ ঘোষ, কৌশিক চন্দ্র, বিকাশ ভট্টাচার্যেরা। হাইকোর্ট ঘুরে মিছিল যায় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম পর্যন্ত।
আইনজীবীদের একাংশের এই সমর্থনের বিপরীতে তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ অন্য অংশ আবার বলছে, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এখন যৌন হেনস্থার অভিযোগ থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে চাইছেন। সেই কারণেই তিন মাস আগের একটা চিঠি তিনি জঞ্জালের ঝুড়ি থেকে তুলে এনেছেন।
হুমকি-চিঠি পাওয়ার এত দিন পরে কেন তদন্তের নির্দেশ দিলেন?
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “সেপ্টেম্বরে চিঠিটা যখন এসেছিল, তখন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন যা চলছে, তাতে ব্যবস্থা নিতেই হল। স্টেট ল’ ক্লার্কস কাউন্সিলের চেয়ারম্যানকে বলেছি তিন সপ্তাহের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে।” কমিশনের রেজিস্ট্রার রবীন্দ্রনাথ সামন্ত জানিয়েছেন, সংশ্লিষ্ট নির্দেশ এ দিন বিকেলেই ডাক মারফত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। কমিশন-সূত্রের ইঙ্গিত, বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় প্রয়োজনে ওই মুহুরির বিরুদ্ধে পুলিশেও অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
উল্লেখ্য, আইনজীবীদের অধীনে কর্মরত মুহুরিদের একদা লাইসেন্স দিতেন সংশ্লিষ্ট আদালতের মুন্সেফ। বর্তমানে মুহুরি-লাইসেন্স মঞ্জুর ও বিশৃঙ্খলার কারণে তা বাতিল করে সংশ্লিষ্ট মুহুরির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরুর ক্ষমতা স্টেট ল’ ক্লার্কস কাউন্সিলের হাতে। কমিশন আশা করছে, তাদের চেয়ারম্যানকে হুমকি-চিঠি লিখেছেন যিনি, তাঁর লাইসেন্সও কাউন্সিল বাতিল করবে।
ল’ ক্লার্কদের রাজ্য অ্যাসোসিয়েশন-ও একই কথা বলেছে। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সুনীল বিশ্বাসের প্রতিক্রিয়া, “অসীমা মালিক নামে ওই মুহুরি আমাদের সংগঠনেরই সদস্য, তিনি বর্ধমান সদর আদালতে কর্মরত। তিনি সাধারণ মহিলা। আমরা বুঝতে পারছি না, রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে এমন চিঠি তিনি লিখলেন কী করে!” সুনীলবাবুর বক্তব্য, “আমাদের সংগঠন পুরোপুরি অরাজনৈতিক। এই ধরনের রাজনৈতিক চিঠি আমরা কোনও ভাবে মেনে নিতে পারি না। অসীমা মালিক যদি সত্যিই এটা লিখে থাকেন, তা হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেব। তাঁর লাইসেন্স বাতিল করা হবে, সংগঠন থেকে সাসপেন্ড কিংবা বহিষ্কৃতও হতে পারেন।” ল’ ক্লার্ক অ্যাসোসিয়েশনের বর্ধমান জেলা সম্পাদক রাজীব চৌধুরীর মন্তব্য, “ক’দিন আগে অসীমা মালিক এক আইনজীবীর সঙ্গে গোলমালে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সেটা আমরা মিটিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে হুমকি দিয়ে চিঠি লেখার মতো এত বড় কাণ্ড যে তিনি ঘটিয়ে ফেলেছেন, তার বিন্দু-বিসর্গ আমরা জানতাম না!”
বিশদ অনুসন্ধানের জন্য তাঁদের সংগঠনের একটি দল আজ, বৃহস্পতিবার বর্ধমান সদর আদালতে গিয়ে অসীমাদেবীর সঙ্গে কথা বলবে বলে জানিয়েছেন সুনীলবাবু। আর রাজীববাবু এ দিন বলেছেন, “আমরা বৃহস্পতিবার সংগঠনের বৈঠক ডেকেছি। সেখানে অসীমাদেবীর কৈফিয়ৎ তলব করা হবে। জানতে চাওয়া হবে, কেন তিনি এমন রাজনৈতিক পক্ষপাতমূলক চিঠি লিখলেন।”
এ দিকে, ইন্টার্ন-কাণ্ডের জেরে রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান পদ থেকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের অপসারণের দাবির বিষয়টি ফের সুপ্রিম কোর্টের কাছে পাঠানোর প্রাথমিক পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক। অশোকবাবুর অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে দু’টি চিঠি লিখেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাষ্ট্রপতি চিঠি দু’টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পাঠিয়ে দেন। তারা আবার আইন মন্ত্রকের পরামর্শ চায়। অশোকবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করে সুপ্রিম কোর্টের একটি কমিটি ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, তিনি ওই ইন্টার্নের প্রতি অবাঞ্ছিত আচরণ করেছিলেন বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করার কারণ আছে। কিন্তু এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব নয় বলেও রায় দেয় ওই কমিটি। আইন মন্ত্রক অবশ্য ফের বিষয়টিকে সুপ্রিম কোর্টের কাছেই পাঠিয়ে দিতে চায় বলে জানা গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত কী করা হবে সে ব্যাপারে আজ, বৃহস্পতিবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র।
|