|
|
|
|
যুব-মন বুঝে সমকামে সায় ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপনেও
সুজিষ্ণু মাহাতো • কলকাতা
|
সমকামিতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় ঘিরে যুবমানসের হতাশার শরিক হল দেশের একাধিক বৃহৎ সংস্থা। আমজনতা তথা ক্রেতাদের মন বুঝেই সমকামী আন্দোলনের সমর্থনে ডিজিটাল মিডিয়ায় একের পর এক বিজ্ঞাপন দিয়েছে আমূল, ফাস্টট্র্যাক, তনিশ্ক, অ্যালান সলি-র মতো সংস্থা। ট্যুইটারের হাত ধরে সেগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েও পড়েছে দ্রুত।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে সমকামী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী বা সমাজকর্মীরা তো বটেই, ফিল্মি তারকা থেকে বিশিষ্ট সাহিত্যিক-সাংবাদিকদেরও অনেকে সরব হন। শুধু সনিয়া বা রাহুল গাঁধীই ‘হতাশ’ নন, দেশের বহু মানুষের মন বুঝে সাবধানে হলেও মুখ খুলেছেন একাধিক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী। যুবমানসের ক্ষোভের আঁচ পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। তা নজর এড়ায়নি দেশের একাধিক বড় সংস্থার। তাদের বিজ্ঞাপনগুলির ভাষাতেও তা স্পষ্ট। বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য মনে করছেন, সামাজিক আন্দোলনকে সমর্থনের এই বার্তার পিছনে রয়েছে অর্থনীতির চাহিদা। |
|
সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের পরে এই বিজ্ঞাপনগুলি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। |
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা ‘অসাংবিধানিক নয়’ বলে বুধবার রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সেই সঙ্গেই খারিজ হয়ে যায় দিল্লি হাইকোর্টের ২০০৯-এর রায়, যেখানে বলা হয়েছিল এই ধারা সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের বিরোধী। দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারী স্বেচ্ছায় সমকামী সম্পর্কে জড়ালে তা আদৌ অপরাধ নয়।
দেশের বৃহত্তম দুগ্ধ সমবায় আমূল চিরকালই চালু বিষয় নিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করায় বিশ্বাসী। তাদের সাম্প্রতিক বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, ফুল হাতে একটি সমাধিফলকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে আমূল-কন্যা। সেখানে লেখা ‘ফ্রিডম অফ চয়েস-২০১৩’। অর্থ স্পষ্ট: স্বাধীন পছন্দের মৃত্যু ২০১৩-তে। ফাস্টট্র্যাকের ক্যাচলাইন বলছে— ‘দ্য রোড টু ইকুয়ালিটি হ্যাজ নেভার বিন স্ট্রেট।’ তাতে ‘স্ট্রেট’ (যার একটি অর্থ সাধারণ যৌন পছন্দের বা বিসমকামী মানুষ) শব্দটি লেখা ‘এলজিবিটিকিউ’ (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার অ্যান্ড কোয়েশ্চেনিং)-এর প্রতীক রামধনুর ছয় রঙে। অ্যালান সলি-র বিজ্ঞাপনেও সেই রামধনুর উপরে লেখা ‘অল কালারস ওয়্যার ক্রিয়েটেড ইক্যুয়াল’। অনলাইন শপিং ওয়েবসাইট ‘বিফোরআফটার ডট ইন’ শপিংয়ের মোট দাম থেকে ৩৭৭ টাকা বাদ দেওয়ার অফার চলছে, যে ক্যাম্পেনের নাম ‘মাইনাস ৩৭৭’।
বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই সামাজিক সাম্যের বার্তার নিয়ন্ত্রক অবশ্য অর্থনীতি। রাম রায়ের মতে, “বিজ্ঞাপন চ্যারিটি নয়, বিনিয়োগ। তাই বিজ্ঞাপনের পিছনে অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য থাকাটাই স্বাভাবিক। তা করতে গিয়ে সামাজিক বিষয়কে ব্যবহার করাটাও ইতিবাচক।” মুম্বইয়ের রঘু ভট্টের বক্তব্য, “দেশের যুব সম্প্রদায়ের কাছে সব ব্র্যান্ডই পৌঁছতে চায়। এই আন্দোলনে যোগদানকারীদের অধিকাংশই যুব সম্প্রদায়ের সদস্য। তাই এই বিষয় নিয়ে যদি কোনও ব্র্যান্ড বিজ্ঞাপন করলে সে যুব সম্প্রদায়ের কাছে নিজের সম্বন্ধে একটা ইতিবাচক ইমেজ তৈরি করতে পারে, যা তার বিপণনে সহায়ক হয়।”
আসন্ন লোকসভা নিবার্চনের আগে যুব-মন পেতে ইতিমধ্যেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে যাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে আসরে নেমেছে কংগ্রেস। আইন সংশোধনের আশ্বাস তো আছেই। কংগ্রেস নেতারাই জানাচ্ছেন, এই সক্রিয়তার সব থেকে বড় কারণ শহুরে মধ্যবিত্ত এবং যুব সম্প্রদায়ের মন জয়ের চেষ্টা। তেমনই ব্র্যান্ড-সক্রিয়তারও বড় কারণ, যুব সমাজের বড় অংশ তাদের পণ্যের উপভোক্তা। রামে রায়ের কথায়, “এই ধরনের বিজ্ঞাপন তো শুধু সমকামীদের কথা ভেবে করা হয়নি, যাঁরা বিষয়টা সমর্থন করেন তাঁদের সকলের কাছেই ব্র্যান্ড পৌঁছতে পারবে।”
বাজারে স্বাধীন পরিচয় তৈরিও গুরুত্বপূর্ণ, জানাচ্ছেন তনিশ্কের বিজ্ঞাপনটির নির্মাতা অরুণ আইয়ার। ওই বিজ্ঞাপনে দেখা যাচ্ছে, এক জোড়া একই রকম কানের দুল। পাশে লেখা, ‘টু অফ আ কাইন্ড অলওয়েজ মেক এ বিউটিফুল পেয়ার।’ অরুণের কথায়, “প্রতিটি মানুষের মতোই প্রতিটি ব্র্যান্ডেরও স্বাধীন সত্তা থাকে। এক জন যেমন অন্যের সঙ্গে কোনও বিষয়ে কথা বলেন, তেমনই ব্র্যান্ডও জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায়। এখন এটা নিয়ে সকলে কথা বলছেন। তাই সাধারণ মানুষের মতোই তনিশ্কও নিজের বক্তব্য জানিয়েছে।” সমকামিতা অপরাধ নয় বলে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দেওয়ার পরেও তাকে স্বাগত জানিয়ে বিজ্ঞাপন তৈরি করেছিল আমূল।
আমেরিকা-ইউরোপে আগেই বিজ্ঞাপনে সমকামিতার প্রসঙ্গ এসেছে। ‘রে ব্যান’-এর বিখ্যাত ‘নেভার হাইড’ ক্যাম্পেনে দেখা গিয়েছিল দু’জন পুরুষ হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটছেন। এখন দেশে-বিদেশে এই প্রয়াসের বাহন ডিজিটাল বিপ্লব। এ বারের সব ক’টি বিজ্ঞাপনই এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রচারে বড় ভূমিকা নিয়েছে জেন-নেক্সটের সঙ্গে ট্যুইটার-ফেসবুকের আত্মীয়তাও। একের পর এক শেয়ারিং আর ট্যুইটে খবর ছড়িয়েছে আলোর বেগে। অরুণের কথায়, “হয়তো বয়স্করাও এ নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু যুবসমাজ ইন্টারনেটে অনেক স্বচ্ছন্দ। তারাই এগুলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।” রঘু বলেন, “আগে কোনও বিজ্ঞাপন বানালে তা সকলের কাছে পৌঁছনোর কথাও ভাবতে হত। সোশ্যাল মিডিয়া কাজটা অনেক সহজ করে দিয়েছে।”
ট্যুইটারে চিত্রপরিচালক ওনির নিজের সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘আই অ্যাম গে অ্যান্ড রিফিউজ টু বি ইনভিসিবল’। তিনি স্বাগত জানাচ্ছেন এই ব্র্যান্ড-উদ্যোগকে। তাঁর মতে, “এগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিবাচক। এর সামাজিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। যাঁদের কথা ভেবে এই ধরনের বিজ্ঞাপন, তাঁরা তো সংখ্যালঘু। তাতে সংখ্যাগুরুর আপত্তিরও আশঙ্কা থাকে। তা সত্ত্বেও ব্র্যান্ডগুলি ঝুঁকিটা নিয়েছে। সেই স্পিরিটটাই শ্রদ্ধা করার মতো।” |
পুরনো খবর: যুব মন জয়ই লক্ষ্য, কটাক্ষ বিরোধীদের |
|
|
|
|
|