যুব মন জয়ই লক্ষ্য, কটাক্ষ বিরোধীদের

১২ ডিসেম্বর
র দেরি করলেন না সনিয়া গাঁধী। মুখ বুজে রইলেন না রাহুলও। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ২৪ ঘণ্টা না কাটতেই কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব মুখ খুলে সরাসরি জানিয়ে দিলেন, শীর্ষ আদালতের সমকামী রায়ে তাঁরা হতাশ। এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চে যাওয়া যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে দলে। তার পরে আইন সংশোধনের বিষয়টি তো আছেই।
গত কাল ৩৭৭ ধারা নিয়ে রায় দেওয়ার সময়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, ধর্ষণ নিয়ে আইন বদলাতে তো সময় নেননি আপনারা। তা হলে এ ক্ষেত্রে এত ঢিলেমি কেন? তাৎপর্যপূর্ণ হল, সে বার আন্দোলনকারীদের পাশে দাঁড়াতে সময় নিয়েছিলেন সনিয়া-রাহুল। এ বারে কিন্তু আর ঢিলেমি করলেন না।
কাল সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে যখন দিল্লি জুড়ে বিস্ময়, হতাশা ও তীব্র ক্ষোভ, তখন সরকারের পক্ষে মুখ খোলেন আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল। তিনি রায় খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। পরে একাধিক মন্ত্রীও রায় নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন। তত ক্ষণে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, সুপ্রিম কোর্ট যে আইন সংশোধন নিয়ে কেন্দ্রের কোর্টে বল ঠেলে দিল, তাতে কংগ্রেস নেতৃত্ব কী বলছে?
তার জবাবই যেন ছিল সনিয়া, রাহুলের কথায়। এক জন দুপুরে বিবৃতি দিলেন, অন্য জন সাংবাদিকদের মুখোমুখি সন্ধ্যায়। দু’জনেরই বক্তব্য, সংবিধানে মানুষের মৌলিক অধিকারের যে কথা বলা হয়েছে, তাতে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে এই আইনে। এই প্রসঙ্গেই সনিয়া ইঙ্গিত দেন, আইন বদল করতে পারে সংসদ। তাঁর বক্তব্য, “আমি আশা করি, সংসদ ভারতের নাগরিকদের স্বাধীনতা সুনিশ্চিত করার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ করবে।” এর পরে পি চিদম্বরম এবং কপিল সিব্বলরাও জানান, সরকার সুপ্রিম কোর্টে কিউরেটিভ পিটিশন দায়ের করবে। যাতে সাংবিধানিক বেঞ্চে এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হয়। তাতেও নিষ্পত্তি না হলে সংসদে বিল এনে আইন সংশোধনের পদক্ষেপ করা হবে। আর যদি সংসদে এখনই তা সম্ভব না হয়, তা হলে অর্ডিন্যান্সের পথেও হাঁটতে পারে সরকার।
দেশ জুড়ে রাজনৈতিক দলগুলি যখন এই রায় নিয়ে বিশেষ বাক্যব্যয় করছে না, তখন কংগ্রেসের এই সক্রিয়তা আলাদা করে লক্ষণীয়। এর সব থেকে বড় কারণ, শহুরে মধ্যবিত্ত এবং যুব সম্প্রদায়ের মন জয়ের চেষ্টা। এ কথা এ দিন বিভিন্ন আলোচনায় কংগ্রেসের নেতারাই জানিয়েছেন। চার রাজ্যে ভরাডুবির পরে এমনিতেই দলের পায়ের তলায় মাটি ঝুরঝুরে হয়ে পড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, রাহুলের প্রচার সত্ত্বেও আস্থা রাখেনি যুব সম্প্রদায়। বলা হচ্ছে, নির্ভয়া কাণ্ডের সময়ে দলীয় নেতৃত্বের সিদ্ধান্তহীনতা বিরাট ধাক্কা দিয়েছে তাদের। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন এক রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে যুব প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলেন সনিয়া। রাহুল কিন্তু সে দিন চুপই ছিলেন। সেটা ভুলই হয়েছিল বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। এ বারে তাই একই ভুল করতে নারাজ তাঁরা। তাই এই তৎপরতা। গোটা সংবাদমাধ্যম যে ভাবে এই নিয়ে প্রচার শুরু করেছে, তার শরিক হতে চাইছেন।
খাদ্য সুরক্ষা বিলের জন্য ধন্যবাদ জানাতে বৃহস্পতিবার কংগ্রেস সভানেত্রীর বাড়িতে এসেছিলেন মুম্বই
প্রদেশ কংগ্রেসের মহিলা শাখার সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন সনিয়া। ছবি: পিটিআই।
কিন্তু এতেও প্রশ্ন উঠেছে, এ বারে দ্রুত মুখ খোলাটা যে সঠিক সিদ্ধান্ত, সেটা কে বলল? কারণ, দলের মধ্যেই বলা হচ্ছে, যুব সম্প্রদায় এবং শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত এই রায়ের পরে সরব হলেও গ্রামীণ মানুষ এবং বিভিন্ন ধর্মের নানা সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অখুশি নয়। যে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রায় দিয়েছে শীর্ষ আদালত, তার পিছনেও রয়েছে ধর্মীয় সংগঠনগুলির আবেদন। এর আগে দিল্লি হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারী স্বেচ্ছায় সমকামী সম্পর্কে জড়ালে তা অপরাধ নয়। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারাকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী অ্যাখ্যা দিয়েছিল তারা। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সর্বোচ্চ আদালতে জানানো আবেদনের পিছনে ধর্মীয় সংগঠনগুলির ভূমিকা কিন্তু কম নয়। তাই সনিয়া-রাহুলের দ্রুত প্রতিক্রিয়া এবং রায়ের বিপক্ষে দাঁড়ানোতে উল্টো ফলও হতে পারে বলে দলের একটি অংশের আশঙ্কা।
আর এক দল আবার বলছেন, সংসদের সামনে লোকপাল বিল থেকে শুরু করে এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। সেখানে হঠাৎ ৩৭৭ ধারা নিয়েই বা এত তৎপরতা কেন? দলেও এই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকাশ্যে সনিয়া-রাহুলের বিরুদ্ধাচরণ সম্ভব নয়। তাই ঘনিষ্ঠমহলে দলের এই নেতারা বলছেন, “গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন বিষয়ে যখন গাঁধী পরিবারের সামনে আসার দরকার ছিল, তখন সে ভাবে তাঁদের দেখা মেলেনি। এখন একটি তুলনায় কম প্রাসঙ্গিক বিষয়ে তাঁরা বড় প্রচারে নামছেন।”
একই সমালোচনা শোনা গিয়েছে বিরোধীদের মুখেও। এই নিয়ে সব থেকে বেশি সরব বিজেপি। তাদের নেতারা জনে জনে মুখ খুলেছেন কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। সেখানে উঠে এসেছে একের পর এক সমালোচনা। যেমন, এক শীর্ষ নেতা বলেছেন, “চার রাজ্যে হারের পরে সনিয়া এখন দৃষ্টি ঘোরাতে চাইছেন। তাই এ নিয়ে এত হইচই। অথচ সরকার যদি চায়, সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার বদলে সংসদেই তো কাল আইন সংশোধন করতে পারে।” তাঁর কথায়, সুপ্রিম কোর্ট তো ৩৭৭-এর বিপক্ষে কথা বলেনি। শুধু সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কেন এই সমকামীদের অধিকার দেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার! আর এক আইনজীবী নেতার মতে, “যাঁরা সমকামী মনোভাব নিয়ে বড় হচ্ছেন, তাঁদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা খুবই দুঃখজনক। এর জন্য সরকারকে ৩৭৭ ধারায় সামান্য রদবদল করতে হবে। তা না করে কংগ্রেস নেতৃত্ব নজর ঘোরানোর কৌশল নিতে চাইছেন। বিজেপি এই ফাঁদে পা দেবে না।”
মজার ব্যাপার হল, এই নেতারা নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নন। সামনে এসে বক্তব্য রাখছেন সুষমা স্বরাজ, মীনাক্ষী লেখির মতো কয়েক জন। কিন্তু তা-ও
রায়ের সরাসরি বিরোধিতার বদলে এড়িয়ে যাওয়ার মতো কিছু কথা বলেছেন তাঁরা। সুষমা যেমন বলেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে আইন সংশোধন করার কথা বলেছে। সরকার প্রস্তাব আনার সময় সর্বদল বৈঠক ডাকুক। তখন আমরা আমাদের মত জানাব।” মীনাক্ষী উল্টে কংগ্রেসকেই দুষলেন। বললেন, “ধারা যতই থাকুক, কেউ এফআইআর না করলে তো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কোনও সমকামীর বিরুদ্ধে। আর ক’জনই বা আজ পর্যন্ত এই নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন? আসলে কংগ্রেস বিতর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে এটিকে ঠান্ডা ঘরে পাঠাতে চায়। সে কারণে এত হল্লা।”
আর বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদ প্রার্থী নরেন্দ্র মোদী? দু’দিন ধরে তাঁকে এ ব্যাপারে টু শব্দটি করতে শোনেনি কেউ। তাঁর ঘনিষ্ঠমহল থেকে বলা হয়েছে, তিনি ব্যস্ত। সময়মতো ঠিকই মুখ খুলবেন।
বিজেপির মতো একই ভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন সিপিএম নেতারাও। আজ দলের বাংলা মুখপত্রেও এই খবরটিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সিপিএম রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু অনেকটা বিজেপির সুরেই বলেন, “আমার মত হল, এটা এমন কোনও জরুরি বিষয় নয়, যার জন্য অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে আদালতকে রায় দিতে হবে। দেশে কত বড় বড় সমস্যা রয়েছে!” সরাসরি সমকামিতার পক্ষে বা বিরুদ্ধে না গিয়ে বিমানবাবুর আরও বক্তব্য, “এটা আইন বা রায় দিয়ে ঠিক করে দেওয়ার বিষয় নয়। সংসদে আলোচনা করলেই বরং ভাল হবে।” সিপিআই নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত অবশ্য জানিয়েছেন, পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সঙ্গে তাল রেখে ৩৭৭ ধারায় পরিবর্তন দরকার।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধান বিরোধী দলের নেতারা চুপ কেন? বিজেপির তরফে বলা হচ্ছে, নেতাদের অনেকেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করলেও স্রেফ ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে চুপ করে আছেন। কারণ মামলার সঙ্গে ধর্মীয় সংগঠনগুলির জড়িয়ে পড়া। এই ব্যাপারে হিন্দু সংগঠনগুলির সঙ্গে সংখ্যালঘুদের মতভেদ নেই। লোকসভা ভোটের আগে তাই মুখ খুলে নতুন বিপদ ডাকতে চাইছে না বিজেপি।
তা হলে সনিয়া গাঁধীরা কি ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিকে তোয়াক্কা করছেন না? মণীশ তিওয়ারি ব্যাখ্যা দেন, “আমরা সমকামীদের অপরাধের আওতার বাইরে রাখার কথা বলছি মাত্র। আজ পর্যন্ত তো এটিকে অপরাধের আওতায় আনা হয়। তাতে কি কোনও কিছু আটকে রয়েছে? নাকি সমকামী পরিচয় দেওয়ার পরে কারও জেল হয়েছে?”
কিন্তু দলের অন্দরে অন্য কথা বলা হচ্ছে। তা হল, মুখ বুজে থাকলে লাভ তো কিছু হবে না। বরং তৎপরতা দেখিয়ে মুখ খুলে যদি যুব সম্প্রদায়ের মন কিছুটা গলে। ঝুঁকি নেওয়া ছাড়া এখন আর পথ নেই। তাতে যদি কিছু লাভ হয়, লোকসভা ভোটের আগে তাই বা মন্দ কী!

সমকামী রায়ে চিন্তিত বচ্চনও
সমকামিতাকে শীর্ষ আদালত অসংবিধানিক ঘোষণা করা নিয়ে চিন্তিত অমিতাভ বচ্চনও। বৃহস্পতিবার অমিতাভ তাঁর ব্লগে লিখেছেন, “সুপ্রিম কোর্ট তার রায়ে বলেছে সমকামিতা অপরাধ। যাঁরা এত দিন পর্যন্ত নিজেদের মতো করে বাঁচার কথা ভাবছিলেন সেই সব মানুষের মধ্যে এর ফলে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। জানি না এ সব আমাদের কোন দিকে নিয়ে যাবে।”

৩৭৭ ধারায় কি শুধু পুরুষ সমকামীরাই অপরাধী?
১৮৬০ সালের এই আইনে প্রকৃতিবিরুদ্ধ দৈহিক সঙ্গমের কথা বলা আছে। ব্যাখ্যায় ‘পেনিট্রেশন’ শব্দটিও উল্লিখিত হয়েছে। সে দিক থেকে এই আইনের প্রাথমিক নিশানা পুরুষ সমকামীরাই। পায়ুসঙ্গমের বিরোধিতা এই আইনের অগ্রাধিকার।

নারী সমকামীরা কি এর আওতায় আসছেন?
আইনজ্ঞদের একাংশের মতে, নারী সমকামীরা এর আওতায় পড়েন না। শারীরবৃত্তীয় কারণেই তাঁদের পক্ষে পেনিট্রেশন করা সম্ভব নয়। অন্য দলের মতে, ভারতীয় দণ্ডবিধির অন্য বিবিধ আইনে পেনিট্রেশনের বিস্তৃত সংজ্ঞা রয়েছে। সেখানে পেনিট্রেশন বলতে শুধু পুরুষাঙ্গ বোঝায় না। প্রকৃতিবিরুদ্ধ শব্দটিরও নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। সেই বিচারে কিন্তু মহিলা সমকামীরাও অপরাধীর তালিকায় আসবেন।

দম্পতিরাও কি এই ধারায় অপরাধী হতে পারেন?
নারী-পুরুষের সম্পর্ক, এমনকী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও নাক গলাতে পারে ৩৭৭ ধারা। বহু নরনারী নিজেদের মধ্যে নানা ধরনের যৌন প্রকরণে অংশ নেন। ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ পেনিট্রেশনের আওতায় তাঁরাও পড়তে পারেন।

বাংলার বাণী

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.