কেন্দ্রের কোর্টেই বল ঠেলল সুপ্রিম কোর্ট
দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারী স্বেচ্ছায় সমকামী সম্পর্কে জড়ালে তা অপরাধ নয় বলে রায় দিয়েছিল দিল্লি হাইকোর্ট। ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ নম্বর ধারাকে সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের বিরোধী বলেছিল তারা। বুধবার সুপ্রিম কোর্ট সেই রায় খারিজ করে বলল, ৩৭৭ ধারা অসাংবিধানিক নয়।
অর্থাৎ সমকামিতার উপরে ফের অপরাধের তকমা ফিরে এল আজ।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি এস জে মুখোপাধ্যায় ও বিচারপতি জি এস সিঙ্ঘভির বেঞ্চ অবশ্য সমকামিতা নিয়ে নৈতিক অবস্থান শোনায়নি। তারা কেবল ৩৭৭ ধারাটির সাংবিধানিকতার দিকটিই খতিয়ে দেখেছে। সে বিষয়ে শীর্ষ আদালতের বক্তব্য, “হাইকোর্ট ৩৭৭ ধারা নিয়ে রায় দেওয়ার সময় অন্যান্য দেশের আইনের তুলনা অনেক বেশি করে টেনেছে। কিন্তু বিদেশি আইন অন্ধ ভাবে এ দেশে প্রয়োগ করা চলে না।” তবে বেঞ্চের বক্তব্য, সংসদ চাইলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ৩৭৭ ধারা সংশোধন বা বাতিল করার কথা ভাবতেই পারে।
সুতরাং সমকামিতা আইনি বৈধতা পাবে কি না, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায় সংসদের উপরেই বর্তাল।
রায় বেরোনোর পর হতাশ সমকামী অধিকাররক্ষা
আন্দোলনের এক কর্মী। বুধবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: এএফপি।
আইনমন্ত্রী কপিল সিব্বল-সহ একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বক্তব্যে, সরকারের তরফে এ বিষয়ে পদক্ষেপ করা হবে বলেই ইঙ্গিত মিলেছে। তবে নির্বাচনের মুখে কেন্দ্র এ রকম স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কতটা সাহসী হবে, সে নিয়ে সংশয়ও রয়েছে নানা মহলে। কারণ নানা ধর্মের সংগঠনই দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের বিরোধিতা করেছিল। হাইকোর্টে রায় খারিজ করার আবেদন জানিয়ে যাঁরা সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন, অধুনা প্রয়াত বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা বি পি সিঙ্ঘল তাঁদের অন্যতম। সুতরাং বিজেপি-সহ একাধিক বিরোধী দল ৩৭৭ ধারা পরিবর্তনে কতটা আগ্রহ দেখাবে, তা নিয়ে কেন্দ্র নিশ্চিত নয়। দিল্লি হাইকোর্টের রায় বেরনোর পরে বিজেপি থেকে সপা, অনেক দলের সাংসদই ব্যক্তিগত ভাবে তাঁদের আপত্তি জানিয়েছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের আজকের রায় নিয়ে অবশ্য কোনও দলই এখনও সে ভাবে মুখ খোলেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু বিজেপি নেতা জানিয়েছেন, ব্যক্তিগত ভাবে তাঁরা ৩৭৭ ধারা বাতিলের পক্ষপাতী। কিন্তু সমাজের কথাও মাথায় রাখতে হবে বলে তাঁদের মত।
সমকামিতার বৈধতা-অবৈধতা নিয়ে এই আইনি লড়াই অনেক দিনের পুরনো। সমাজ ও রাজনীতিতে বিতর্ক তার চেয়েও বেশি পুরনো। ব্রিটিশ জমানায় লর্ড মেকলের তৈরি আইন, ৩৭৭ ধারায় বলা আছে কোনও পুরুষ, নারী বা পশুর সঙ্গে স্ব-ইচ্ছায় প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ যৌন প্রকরণে লিপ্ত হলে তা অপরাধ। এতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। আইনে আলাদা করে সমকামিতাকে বেআইনি বলা হয়নি। ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ যৌন সংসর্গকে অপরাধ বলা হয়েছে এবং সমকামীরা তার আওতায় চলে এসেছেন। যদিও খোদ ইংল্যান্ডে সমকামিতা বৈধতা পেয়ে গিয়েছে ১৯৬৭ সালেই। আন্তর্জাতিক দুনিয়ার বড় অংশেই এখন সমকামিতা আইনি স্বীকৃতি পেয়েছে। সম্প্রতি ভ্যাটিকানও তার মনোভাব বদলানোর ইঙ্গিত দিয়েছে। আমেরিকা-সহ বহু দেশে সমকামী অধিকার আন্দোলন সমকামী বিবাহের স্বীকৃতি চাওয়ার পর্বে পৌঁছে গিয়েছে। সফলও হয়েছে অনেকাংশে। আগামী বছর ইংল্যান্ডেও প্রথম সমকামী বিবাহ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।
৩৭৭ ধারা কী
(ভারতীয় দণ্ডবিধি)
• যে কোনও ব্যক্তি স্ব-ইচ্ছায় কোনও পুরুষ, মহিলা বা পশুর সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ যৌন ক্রিয়ায় লিপ্ত হলে তার সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড ও জরিমানা হতে পারে।

• যে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি স্ব-ইচ্ছায় যে যৌন প্রকরণে অংশ নেবেন, তাকে অপরাধ বলে দেগে দেওয়া মানে ব্যক্তির মৌলিক অধিকার হরণ করা।
দিল্লি হাইকোর্ট। ২ জুলাই, ২০০৯
• ৩৭৭ ধারা অসাংবিধানিকতার দোষে দুষ্ট নয়। ফলে হাইকোর্ট যা বলেছিল, তা আইনত অচল। তবে আইনসভা চাইলে ধারাটি সংশোধন বা বাতিল করতে পারে।
সুপ্রিম কোর্ট | ১১ ডিসেম্বর, ২০১৩
• আমি চূড়ান্ত হতাশ। এই রায় মৌলিক মানবাধিকারের বিরোধী। অসহিষ্ণুতার প্রকাশ। এটা লজ্জার।
আমির খান, অভিনেতা
• আইনের সাংবিধানিকতা খতিয়ে দেখা সুপ্রিম কোর্টের কাজ। তারা সেটা করেছে। আইন তৈরি করা আমাদের কাজ। আমরা সেটা করব।
কপিল সিব্বল, আইনমন্ত্রী
• আমার ব্যক্তিগত মত, এই রায় পশ্চাৎমুখী। আধুনিক উদারমনস্ক ভারতের প্রতি সুবিচার হল না। যদি দু’জন পুরুষ এবং দু’জন মহিলা পরস্পরের সঙ্গে স্বচ্ছন্দ হন, সেটা বেআইনি কেন?
জয়রাম রমেশ, গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী
• ৩৭৭ ধারা শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়। এই আইনে আমাদের গণতন্ত্রকে প্রহেলিকা বলে মনে হয়।
কর্ণ জোহর, পরিচালক
এ দেশেও গত দেড়-দু’দশকে সমকামিতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বেড়েছে। শিল্প-সাহিত্য-ফ্যাশন এবং সিনেমার জগতের বহু সেলিব্রিটি প্রকাশ্যে নিজেদের সমকামী যৌন পরিচয়ের কথা স্বীকার করেছেন। লেখায়-আঁকায়-পর্দায় বাস্তবতার প্রতিফলনও ঘটেছে। একাধিক সংগঠন সমকামীদের জন্য আইনি স্বীকৃতি চেয়ে রাস্তায় নেমেছে। তেমনই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ৩৭৭ ধারা বাতিলের আর্জি জানিয়ে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা করেছিল ২০০১-এ। ২০০৪-এ সেই মামলা খারিজ হয়ে গেলে সংগঠনটি সুপ্রিম কোর্টে যায়। শীর্ষ কোর্টই তখন মামলাটি হাইকোর্টে ফেরত পাঠিয়ে গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে বলে। ২০০৯-এ হাইকোর্ট রায় দেয়, স্বেচ্ছায় দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বা নারী যৌন সম্পর্কে জড়ালে তা অপরাধ নয়।
হাইকোর্ট তখন কী যুক্তি দিয়েছিল? রায়ে বলা হয়েছিল, ৩৭৭ ধারা তার বর্তমান চেহারায়, নাগরিকের মৌলিক অধিকারের বিরোধী। আদালত অবশ্য ৩৭৭ ধারা সম্পূর্ণ বিলোপ করার কথা বলেনি। অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সঙ্গে যৌনসংসর্গ ও বলপূর্বক যৌনসংসর্গের শাস্তি পুরোমাত্রায় বহাল রাখা হয়।
৩৭৭ ধারা সংশোধন করার পরামর্শ অবশ্য রায় ঘোষণার আগেও কেন্দ্রকে দিয়েছিল আদালত। কিন্তু সরকারের অন্দরমহলে এ বিষয়ে যথেষ্ট টালবাহানা ছিল। ইউপিএ-র প্রথম দফায় স্বাস্থ্য এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। এই আমলেও স্বাস্থ্য, স্বরাষ্ট্র এবং আইন মন্ত্রক দীর্ঘদিন ঐকমত্যে আসেনি। সুপ্রিম কোর্টেও শুনানির সময়ে কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা করে বিচারপতিরা বলেছিলেন, সমকামিতাকে অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার বিষয়টিকে রীতিমতো অবহেলা করছে তারা।

সুপ্রিম কোর্টে চূড়ান্ত শুনানির সময় অবশ্য বিভিন্ন মন্ত্রকের মধ্যে মতভেদ তেমন ছিল না। বরং সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার পক্ষেই মত দিয়েছিল কেন্দ্র। অ্যাটর্নি-জেনারেল জি ই বাহানবতী সওয়াল করেন, আইনের এই ধারা ভারতীয় সমাজের উপরে চাপিয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকরা। আসলে ভারতীয় সমাজ সমকামিতার প্রতি অনেক বেশি সহনশীল। স্বাস্থ্য মন্ত্রকও তাদের একটি হলফনামায় জানায়, দেশে প্রায় ২৫ লক্ষ সমকামী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রায় ৭% অর্থাৎ ১ লক্ষ ৭৫ হাজার মানুষ এইচআইভি সংক্রমণে ভুগছেন। সমকামিতা আইনি স্বীকৃতি পেলে তাঁদের চিকিৎসার সুযোগ বাড়বে।
আজকের রায়ে সমকামী আন্দোলন কর্মীদের উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। নানা প্রান্ত থেকে শীর্ষ আদালতে আসেন অনেকে। রায় শুনে দৃশ্যত শুকিয়ে যায় তাঁদের মুখ। বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ-মিছিল। সুপ্রিম কোর্টে সমকামীদের পক্ষে আবেদনকারীদের দলে ছিলেন কলকাতার চার বাবা-মা। রায় শুনে তাঁরাও হতাশ। তেমনই এক মা বীণা গুহঠাকুরতা বলেন, “আমি চাই, আমার ছেলে নিজের ইচ্ছে মতো জীবন কাটানোর অধিকার পাক।”
সমকামীদের আন্দোলন তাই এখানে শেষ হচ্ছে না। গুজরাতের রাজপরিবারের সদস্য মানবেন্দ্র সিংহ কুমার গোহলি বলছেন, লড়াইটা আসলে এ বার শুরু হল। তাঁর কথায়, “৩৭৭ ধারা শুধু সমকামী যৌনতাকে আইনবিরুদ্ধ বলে না। নারী-পুরুষের নানা যৌন প্রকরণও তার মধ্যে পড়ে।” কলকাতার ফ্যাশন ডিজাইনার নীল বলছেন, “হাইকোর্টের রায়ের পরে সমকামী আন্দোলনে একটা আত্মসন্তুষ্টি এসে গিয়েছিল। এর পর আবার নতুন করে ঝাঁপাতে হবে।” হতাশ চিত্রপরিচালক ওনির বলছেন, জানি না কী করব। সেন্সর বোর্ড এ বার বহু ছবিকেও আটকাবে!
নতুন করে শুরুর পথ অবশ্য রয়েছে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। আইন বদলের সুযোগ তো রয়েছেই। খোদ সুপ্রিম কোর্টও তার রায়ে এ কথা বলেছে। বরং হাইকোর্টের রায় খারিজ করার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম যুক্তিই ছিল, দেশের আইনসভা যখন আইন পরিবর্তন বা সংশোধনে উৎসাহী নয়, তখন বিদেশি দৃষ্টান্ত দেখিয়ে সেই আইনকে অসাংবিধানিক বলা যায় না। নির্ভয়া মামলার উল্লেখ করে আদালতের পর্যবেক্ষণ ধর্ষণ আইন বদলের ব্যাপারে কেন্দ্র যে সক্রিয়তা দেখিয়েছে, ৩৭৭ ধারার ব্যাপারে তা দেখায়নি। ১৭২তম আইন কমিশন ৩৭৭ ধারা বিলোপের সুপারিশ করলেও তা কার্যকর হয়নি।
কেন্দ্র এ বার নড়ে বসবে কি? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই রায় নিয়ে ইতিমধ্যেই ফলাও করে লেখালেখি হচ্ছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা মানছেন যে, বিশ্বের সামনে ভারত সম্পর্কে ভুল বার্তা যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় রাগ-ক্ষোভ ফুটে বেরোচ্ছে। ভোটের ময়দানে এই সব যুক্তি খাটবে কি না, সেটাই সরকারের সামনে বড় প্রশ্ন। সেমিফাইনালে বিপর্যস্ত হয়ে এমনিতেই মুষড়ে রয়েছে কংগ্রেস। এই অবস্থায় আইন বদলের ঝুঁকি তারা আদৌ নেয় কি না, সেটাই দেখার।

এটা নীতি বা ধর্মের প্রশ্ন নয়। জীবনযাত্রা কী ভাবে অবৈধ হতে পারে?
জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী
এটা শেষ নয়, বরং লড়াইয়ের শুরু।
গুজরাত রাজপরিবারের সদস্য
এই রায় বর্বরতা আর মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া।
সমাজবিজ্ঞানী
কী? ২০১৪ সালে সমকামী সম্পর্ক অবৈধ?
লেখক

সুপ্রিম কোর্ট আজ ভুল করেছে।
পরিচালক, অভিনেতা
যখন আমরা মঙ্গলযান পাঠাচ্ছি, তখনও আমরা সমানাধিকারে বিশ্বাস করি না।
অভিনেতা

কিছু ভাবতে পারছি না। দিল্লি হাইকোর্টের রায় নাকচ হলে দেশ ছাড়ব ভেবেছিলাম।
পরিচালক
রায়টা ভাল করে বুঝতে হবে। সংসদীয়
স্ট্যান্ডিং কমিটি এই বিষয়ে আলোচনা করবে।
রাজ্যসভার সাংসদম
একটা ঐতিহাসিক সুযোগ হারিয়ে গেল।
এটা মধ্যযুগীয় মানসিকতার পরিচয়।
অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হতাশ। স্বাধীনতা শব্দটাই ধাঁধার মতো লাগছে।
অভিনেত্রী
সরকার এই বিষয়টিকে অপরাধের
তালিকা থেকে বার করে আনার পক্ষপাতী।
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী
ভারত সম্পর্কে সারা বিশ্বে
খুব ভুল বার্তা যাচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও জাহাজ প্রতিমন্ত্রী

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.