প্রবন্ধ ১...
ঢেউ উঠছে
ওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ছাত্রভোটে সি পি আই এম-এর অনুগামী ছাত্র সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে লড়তে নেমেছিলেন গৌরব ঘোষ। সমকামী গৌরব তাঁর যৌনতা নিয়ে কোনও লুকোছাপা করেননি। কলকাতার বাড়িতে মা-বাবাকে ‘স্যাফো ফর ইকোয়ালিটি’র পত্রপত্রিকা পাঠাতেন। ‘সমকামী’ শব্দটি অচল হয়ে পড়ছে, সারা দুনিয়া ওঁদের এখন এলজিবিটি (লেসবিয়ান গে বাইসেকশুয়াল ট্রান্সজেন্ডার) নামেই জানে।
গৌরব অবশ্য ভোটে হেরে গিয়েছেন। প্রকাশ কারাট, সীতারাম ইয়েচুরিদের আঁতুড়ঘরে এ বার মাওবাদী ছাত্র সংগঠন আইসা-র (অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন) রমরমা। কিন্তু গৌরবই এস এফ আই-এর অন্যান্য প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে! জয়পরাজয় বড় নয়। গৌরবের প্রার্থী পদই ছিল উজ্জ্বল উদ্ধার। ভাবা গিয়েছিল, যাক, ছাত্র সংগঠন সামাজিক ছুতমার্গের বিরুদ্ধে লড়ার সাহস রাখে। বিশেষত যখন মনে পড়ে, জেএনইউ’তেই সাত বছর আগে গৌরবের হোস্টেলও জোটেনি!
কিন্তু চমক দিলেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। গৌরবের প্রার্থী হওয়া নিয়ে তাঁর বক্তব্য, “এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। বামপন্থীরাই সব সময় সামাজিক বেড়া ভাঙার কথা বলেন।” তাই নাকি? মনে পড়ল, বছর তিনেক আগে ফিদেল কাস্ত্রো এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি ক্ষমা চাইছি। বিপ্লবের পর আমাদের দেশেও এলজিবিটিদের ওপর অত্যাচার হয়েছিল।” কাস্ত্রো ইতিহাসকে স্বীকার করে ক্ষমা চান, আর তরুণ ঋতব্রত ইতিহাসকে এড়িয়ে দলীয় অহঙ্কারের স্লোগান আওড়ান। এস এফ আই-এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, সন্দেহ নেই!
ক্ষমাপ্রার্থনা আত্মশ্লাঘা
ফিদেল কাস্ত্রো। ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়।
কমিউনিস্টরা কী ভাবে এলজিবিটি আন্দোলনকে পিষে মেরেছেন, তার উদাহরণ প্রচুর। এবং এ ব্যাপারে তাঁরা সামাজিক ঐতিহ্যের ধুয়ো তুললে সে অজুহাত ইতিহাসের ধোপে টিকবে না। রাশিয়ার কথাই ধরা যাক। জারের আমলে ‘অন্য’ যৌন আচরণ আদৌ অপরাধ হিসেবে গণ্য হত না। কিন্তু ১৯৩৩ সালে স্তালিনের আমলে দেশের সংবিধানে জুড়ল ১২১ ধারা: সমকামিতা মানেই পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড, সাইবেরিয়ায় নির্বাসন। এই আইন প্রত্যাহার করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার বহু পরে, ১৯৯৩ সালে। পূর্ব ইউরোপের নানা দেশেই একই কাহিনি। বিশ শতকের গোড়ায় জার্মান শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী লিলি ব্রাউন সমকামিতাকে ‘অপরাধ’ বলে গণ্য না করার কথা বলতেন। তিনি আম্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে বিতাড়িত হন।
কাকাজেঠাদের পথে হাঁটতে হাঁটতে ভারতীয় কমিউনিস্টরা বৃদ্ধ প্রপিতামহদের কাছেও পৌঁছে যেতে পারেন। কার্ল হাইনরিখ উলরিখ্স উনিশ শতকে প্রথম এলজিবিটি মুক্তি-আন্দোলন করেন। মার্ক্স ও এঙ্গেলসকে নিজের লেখা বইও পাঠান। বই পাওয়ার পর ১৮৬৯ সালের ২২ জুন মার্ক্সকে লেখা এঙ্গেলসের চিঠিতে উলরিখের ‘প্রকৃতিবিরোধী জঘন্য কাজ’, ‘নোংরা অশ্লীলতা নিয়ে তত্ত্ব করার চেষ্টা’ ইত্যাদি বিষয়ে নানা তীব্র মন্তব্য রয়েছে।
এশীয় কমিউনিস্টরা কিন্তু এ বিষয়ে তুলনায় উদার। কোনও দিনই ঘোর স্তালিনপন্থী নন তাঁরা। আইনের দৃষ্টিও ক্রমশ স্বচ্ছ হয়েছে। চিনে ১৯৯৭ সাল থেকে এলজিবিটি’রা আর অপরাধী বলে গণ্য নন। ২০০২ সালে ‘মানসিক রোগ’-এর তালিকা থেকেও তাঁরা বাদ। নারীবাদী তাত্ত্বিক, এলজিবিটি মুক্তি-আন্দোলনে অন্যতম নেত্রী, লি ইনহে পার্টির সদস্য, সমকামী বিয়ে আইনসিদ্ধ করার প্রস্তাবও দাখিল করেছেন। ভিয়েতনামে এলজিবিটিদের ওপর অত্যাচার চলত। গত বছর সেখানে মহা উৎসাহে ‘গে প্রাইড প্যারেড’ পালিত হয়। সমকামী বিয়ে নিয়ে সেখানে সরকারি স্তরেও নানা আলোচনা। হো চি মিনের বিপ্লবভূমিই হতে পারে সমকামী বিয়েকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম এশীয় দেশ। গৌরবের প্রার্থী-পদ নিয়ে খুদে নেতারা তাই এশীয় সংহতিকে অন্য আলোয় দেখাতে পারতেন।
তবে এলজিবিটি দমনে কমিউনিস্ট-বিরোধীরাও ধোয়া তুলসীপাতা নন। ঠান্ডা যুদ্ধের আমেরিকায় তখন ম্যাকার্থি-জমানা। সেনেটর ম্যাকার্থির বক্তৃতা, ‘আমেরিকার শত্রু কারা? সমকামী কমিউনিস্টগুলো!’ পরিহাস বটে! স্তালিনরা ভাবছেন: সমকামিতা হল বুর্জোয়া সমাজের অসুস্থতা, নতুন বিপ্লবী সমাজে রোগীদের স্থান নেই। ম্যাকার্থিরা বলছেন: এটি সাম্যবাদী সমাজের রোগ, অসুস্থ কমিউনিস্টরাই পারিবারিক সভ্যতায় অন্তর্ঘাত ঘটায়। আসলে কোনও মেনস্ট্রিম ক্ষমতা-র বয়ানই এলজিবিটিদের ছেড়ে দেয়নি। ফরাসি ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক মিশেল ফুকোর মন্তব্য মনে পড়ে: “ট্রুম্যানের আমেরিকা আর স্তালিনের রাশিয়া... কারা সভ্য বলা সম্ভব না কি!” প্রসঙ্গত, সমকামী ফুকো পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন। তিন বছরের মধ্যে পার্টি ছেড়ে দেন। মনে পড়ল, ওই সময়েই সিমোন দ্য বোভোয়া-র সদ্য-প্রকাশিত ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইকেও ফরাসি পার্টির তাত্ত্বিকরা নস্যাৎ করে দেন: নারীমুক্তি আবার কী? সমাজের বদল হলে ও সব আপনিই হবে।
যৌনতার আধুনিক তত্ত্ব বলে, হোমোসেকশুয়াল বনাম হেটেরোসেকশুয়ালের দ্বিমেরু বিভাজন নিতান্তই অর্বাচীন। ১৯২০ সালের আগে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে ‘হোমোসেকশুয়াল’ শব্দ ঠাঁই পায়নি। হোমো গ্রিক শব্দ, সেকশুয়ালিটি লাতিন। দুইয়ে মিলে ওই হাঁসজারু। মেনস্ট্রিম সমাজ হোমোসেকশুয়ালদের আলাদা চোখে দেখে কেন? প্রত্যেকেই নিজের শরীরকে ভালবাসতে চায়, কিন্তু নিজের কাছে স্বীকার করতে চায় না। আত্মপ্রীতির গূঢ়ৈষা চাপা দিতেই লোকে এলজিবিটিদের নিয়ে আতঙ্কে ভোগে। অস্বস্তিতে তো বটেই।
সেই আতঙ্ক বা অস্বস্তি নানা ভাবে নিজেকে প্রকাশ করে ফেলে। গৌরব সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়ার পরে তাঁর দলের সর্বভারতীয় সম্পাদকের মন্তব্য, “ও তো আর এলজিবিটি বলে ভোট পায়নি। ভাল কর্মী, তাই।” যিনি বলছেন, তাঁর মনটিকে মুহূর্তে চিনে নেওয়া যায়। এই মন বদলাতে পারলে নতুন ইতিহাস তৈরি হত। কিন্তু ইতিহাস তৈরি নয়, ‘ঐতিহাসিক ভুল’ করাই তো ভারতীয় কমিউনিস্টদের বরাবরের ঐতিহ্য।
তবু গৌরবদের কুর্নিশ জানাতেই হয়। ‘আইসা’ বা ‘ডি এস এফ’-এর মতো অতি বাম ছাত্রসংগঠন আজও এলজিবিটি ছাত্রছাত্রীদের প্রার্থী করার সাহস দেখায়নি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন দখল করেছে যারা, সেই বিজেপি-র অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের কাছে তো এলজিবিটি মানে বিদেশি, বিজাতীয় পাপ ছাড়া কিছুই নয়! শুধু স্তালিন এবং ফিদেল কাস্ত্রো নন, গোলওয়ালকর, নরেন্দ্র মোদীদের হিন্দুত্বও ‘মাচিসমো’ বা মারকুটে পৌরুষে বিশ্বাসী। অন্য যৌনতার বিকল্প নিয়ে কথাই চলবে না। দীপা মেটার ‘ফায়ার’ ছবির সময় কারা যেন সিনেমা হলে হামলা করত?
পশ্চিমবঙ্গ? কিছু না বলাই শ্রেয়। সদ্য জাগ্রত ছাত্রদলটিতে শুধুই মাচিসমো, বিকল্প বয়ান নেই। প্রবীণ সি পি এম ও তার ছাত্রছাত্রীদের বোঝার সময় এসেছে, ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হলে প্রহসনের জন্ম হয়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.