প্রবন্ধ ২...
যে কৈশোর হারিয়েছি এবং হারাইনি
কিছু ক্ষণের জন্য নিজস্ব কৈশোর খুঁজে পাওয়া। দলবাঁধা হুল্লোড়েও সেই কৈশোর মাঝে মাঝে একা; ক্লাসরুমে শিক্ষকের নিষ্ঠুর বিদ্রুপে বিদ্ধ অপদস্থ সময়, আর বাড়ি ফেরার পথে বাংলার অনন্য সবুজে ভরাট ছায়াসঙ্গী একাকিত্ব। গার্লস স্কুলের দিদিমণি, উঁচু ক্লাসের শাড়ি-পরা দিদিরা পরির মতো নেমে আসত, দিনান্তে সূর্যাস্তের রঙে, মধ্যযামে নিশ্ছিদ্র আঁধারে কিংবা প্রত্যুষের মলিন চাঁদে।
জীবনের অঙ্গে অঙ্গে ধুলো মাটি কাদার পরত, বয়সের তলায় চাপা পড়া কিশোরবেলার পাখা মেলা মন ও স্বভাব। চাপা পড়া বিস্মরণ নয়। মাঝে মাঝে ছোটখাটো সৌভাগ্যবেলায় নিজের কৈশোর খুঁজে পাওয়া, যেমন এখন ‘ফড়িং’-এর হাত ধরে। তার একটা পোশাকি নাম আছে। কিন্তু সে কেবল স্কুলের খাতায়, যেখানে তার নামের পাশে কলঙ্কলিপি: ‘ডিটেন্ড’! কেন না, সে তো ফড়িং— মা, বাপ, নিতাইদা, সহপাঠী বন্ধুরা ভুলেও সুনামে ডাকে না। সে হারিয়ে যায় নানান অচেনা জগতে, পরীক্ষার খাতায় সাজাহানের শাসনব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে লিখে আসে সাজাহান আর মুমতাজমহলের প্রথম দর্শনের বিবরণ। ‘রেজাল্টের দিন অন্তত ক্লাসে একটু মন দে বাবা’— স্যরের মোলায়েম, বিধ্বংসী ভর্ৎসনায় যখন চমক ভাঙে, তত ক্ষণে তার জন্য জমা হয়ে যায় অনেক উৎকণ্ঠা, আক্ষেপ, প্রহার, আগামী স্বপ্ন, সংশয় এবং ভালবাসার এক অধরা নির্মাণ, যে নির্মাণে রূপ পায় সমাজের ক্রূর এক ছবি, তার সহমর্মী এক প্রতিমা।
ক্রূরতা কি শুধু দৈহিক রক্তক্ষয়ী হিংসাতেই প্রকট? তার চেয়েও বলশালী প্রকাশও তো আছে— যেমন তার আচার বিক্রি করা মাকে দেখিয়ে নবাগতা শিক্ষিকার দিকে তাকিয়ে অভিজ্ঞ শিক্ষকের মিচকে হাসি, স্নিগ্ধ চাতুর্যে ঢেলে দেওয়া শ্রেণি-বিভাজনের বহতা গরল। নতুন দিদিমণিটি যেন ফেল করা ছেলেটার উপর আস্থা দেখিয়ে এক মস্ত অপরাধ করেছেন— বিত্তহীনের আবার লেখাপড়া!
‘ফড়িং’ ছবির একটি দৃশ্য।
গল্পের শেকড় বিস্তৃত সমাজের সরলে, জটিলে। তারই এক শেকড় স্কুলের হেডমাস্টার, পরম্পরার প্রতিমূর্তি: ‘তোমরা কথা বোলো না, আমার কথা শোনো।’ আবার তারই আর এক শেকড় সেই শিক্ষিকা, আইনস্টাইনের ফেল করার গল্প দিয়ে যিনি পড়ানো শুরু করেন। গল্প করতে করতে, পুরনো খাতা ঘাঁটতে ঘাঁটতে জেনে যান ফড়িংয়ের ভেতর বাস করা কল্পনার বাস্তবকে। যে কল্পনাবিলাসের জন্য তার পড়াশোনা হচ্ছিল না, অন্য রকম শিক্ষিকা সেটাকেই তার ক্ষমতা করে তুলতে চান।
সে তো কল্পনায় ভাসে; সে কল্পনা ডিসকভারি চ্যানেল, অ্যানিমাল প্ল্যানেট, ন্যাশনাল জিয়োগ্র্যাফিক থেকে শাখা মেলে। আমাদের কালের ফড়িংদের জন্য এ সব ছিল না, কিন্তু এগুলো তো শাখামাত্র, কল্পনার কাণ্ডটা তো পোঁতা আছে যৌবনোদ্গমের চৌকাঠে দাঁড়ানো সময়ে, যে সময়ে সে স্বপ্ন দেখে, কল্পনায় দেখে তারই একান্ত এক হয়ে ওঠা প্রিয়জনের ছবি। আর তার কল্পনার ছায়াপথ ধরে আমরা যত ক্ষণে আপন স্মৃতির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াই, তত ক্ষণে ‘ফড়িং’ ছবির পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী আমাদের সামনে তুলে ধরেন এমন এক পশ্চিমবঙ্গকে, যেটা আছে বলেই আমরা রয়েছি, অথচ সেটা যে আছে, সেটাই বড় অস্বস্তিকর, বেমানান, অতএব তার খবর নিতে ভুলে যাওয়াটা সাবলীল। সেগুলোর কথা আজকাল আর লেখকরা, শিল্পীরা, বিদ্বজ্জনরা বড় একটা মনে করাতে চান না, দু’এক জন যাঁরা চান তাঁরা আমাদের ভেতরের ফড়িংকেও আমাদের সামনে হাজির করেন।
শিমুলগঞ্জের ২ নং ফকিরপাড়া লেনের যে বাড়িটাতে ফড়িংয়ের বিছানা, সে রকম অজস্র ছাতাপড়া, ফাঁকফোকরে ভরা বাড়ির বাসিন্দাদের সুখদুঃখ, যন্ত্রণা, আনন্দের প্রতিনিধি হয়ে ফড়িংয়ের সঙ্গে উঠে আসে অসামান্য কতকগুলো মানুষী চরিত্র। গোটা ছবি জুড়ে থাকে উদ্যমী সবুজের বিস্তার, তার মাঝে মানুষের অসহায়তার ভাঙাচোরা ইটপাথর, এবড়োখেবড়ো রাস্তা, নোনাধরা দেওয়াল ও নিত্যক্ষণ বেঁচে থাকার কঠোর আশ্বাস।
সে দেওয়ালের টিকটিকিটাও ইন্দ্রনীলের চোখ এড়ায় না। ক্যামেরা তাক করার আগে তিনি ঠিকঠাক দেখে নেন পরিত্যক্ত কারখানা, ক্লাবঘর, দেওয়াল, ট্রেনের বেঞ্চি, খাবারের দোকানের টিভি সেট, পুলিশের আধো-চুল মাথা— ঠিক যেমনটা থাকে তেমনটাই আছে কি না। এমনকী দেওয়ালে DANGAR বানানটা যেন ওই রকমই থাকে, সে দিকেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি। তাঁর চোখে জেগে থাকে সহনাগরিকের মর্মব্যথা, আনন্দের ভাগীদারি। এই সহমর্মিতা বঙ্গসাহিত্য ও নন্দন চত্বর থেকে উঠে যাওয়ার জোগাড় বলেই ফড়িং আমাদের কৈশোর ফিরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে আরও অনেক কিছু দিয়ে যায়। ডটম্যাট্রিক্স প্রিন্টারের আওয়াজ দিয়ে শুরু হওয়া ছবিটা গল্প বলতে বলতে আমাদের হাঁটিয়ে পার করে নিয়ে যায় অনেক মেঠো পথ, সে পথে যেতে যেতে আমরা শুনি ফড়িংয়ের আপাত-কুঁকড়ে-থাকা, আত্মবিশ্বাসহীন কণ্ঠস্বর, যা আসলে স্বপ্নের এক রূপ। আমাদের পাশে পাশে চলতে থাকেন দোকানি, পুলিশ, বাবা-মা এবং এক অসামান্য শিক্ষিকা— এই সব চরিত্রকেই আমরা রোজ যেমন দেখি, তেমনই তাঁদের হাঁটা, চলা, বাক্যক্ষেপ। আমরা নিজেদের ছবি দেখি।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.