মাতৃভক্তি ও মাতৃবন্দনা নিয়ত চলিতেছে। মাতা সন্তানকে বুক দিয়া আগলাইয়া রাখিবেন, তিনি সন্তানের জন্য যে কোনও ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত: স্বতঃসিদ্ধ ধরিয়া লওয়া হয়। যদি বা কুসন্তান হয়, কুমাতা কখনওই হইবে না, হইতে পারে না। এই ধারণার মধ্যে অনেকটা সত্য রহিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু মাতা মাত্রেই তাঁহার বক্ষে পবিত্র স্নেহের ও নিঃস্বার্থ শুশ্রূষার বন্যা ডাকিতেছে: ভাবনার পিছনে বহুল পরিমাণ সংস্কার ও অতিনাটকও কাজ করিতেছে। বাস্তবের দিকে কড়া করিয়া চাহিলে আমরা বহু মাতা দেখিতে পাইব যাঁহারা সন্তানের প্রেমের বা যৌনতার সকল সুযোগের ঘাড় মটকাইতেছেন, বা সন্তানের ব্যক্তিগত পরিসরকে খর্ব করিয়া তাহার সত্তার প্রকৃত বৃদ্ধি নষ্ট করিতেছেন। ইদানীং সংবাদপত্রে ‘সম্মান রক্ষার্থে হত্যা’র যে ঘটনাগুলি প্রকাশিত হয়, প্রায় সকল ক্ষেত্রে হয় মা নিজে হত্যা-প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকেন অথবা কাজটিতে তাঁহার পূর্ণ সমর্থন থাকে। প্রসব করিবার ক্ষমতা একটি জৈবিক ক্ষমতা। ইহাতে কাহারও হৃদয়বৃত্তি স্বতঃই মহৎ হইয়া উঠে না। সন্তানকে লালন করিয়া তোলা ও এক আদর্শ জীবনে শিক্ষিত করা অতি কঠিন কাজ, যাহা করিতে গেলে পূর্বে নিজেকে এক উত্তম মানুষ হিসাবে গঠন করিতে হয়। আমাদের চতুষ্পার্শ্বের মায়েরা সন্তানকে বন্ধুর ক্ষতি করিয়া প্রতিযোগিতায় জিতিতে অনুপ্রাণিত করেন, আত্মসমীক্ষার পরিবর্তে নিজের দুর্দশার জন্য সর্বদা অন্যকে দোষারোপের জঘন্য অভ্যাসে দীক্ষিত করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য তাঁহারা এই ইতরতাগুলি সন্তানকে অকৃত্রিম ভালবাসিয়াই শিখাইয়া থাকেন। যেমন বহু প্রাণী তাহার একাধিক সদ্যোজাতের কয়েকটিকে আন্তরিক উৎসাহে খাইয়া লয়, এই ভরসায় যে খাদ্যের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও বাকি কয়েকটি বাঁচিবে। এক প্রজাতির ঈগল চুপ করিয়া অন্য দিকে তাকাইয়া থাকে, যখন তাহার বাসার মধ্যে বড় বাচ্চাটি ছোট ও দুর্বল বাচ্চাগুলিকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। পান্ডা ভল্লুক-মা, দুইটি বাচ্চা হইলে একটিকে যত্ন করে, অন্যটিকে ফেলিয়া চলিয়া যায়। প্রাকৃতিক সমীকরণ এই কর্মগুলিকে সমর্থন করিলেও, যে শাবকগুলি পরিত্যক্ত বা নিহত হইতেছে, তাহাদের নিশ্চয় মাতৃস্নেহের তত্ত্বটি সত্যাশ্রয়ী মনে হয় না।
সম্প্রতি মার্কিন এক সন্তান মায়ের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ‘শোকবার্তা’ প্রকাশ করিল: ‘তাঁহার আট সন্তানের ছয় জন বাঁচিয়া আছে, যাহাদের যত রকম সম্ভব অত্যাচার করিয়া তিনি জীবন কাটাইয়াছেন। ...যে সন্তানদের তাঁহার অশুভ হিংসাজর্জর জীবনে অংশী করিয়াছেন, তাঁহাদের পক্ষ হইতে অতিশয় আনন্দের সঙ্গে তাঁহার পরলোকগমন উদযাপন করিতেছি, এবং কামনা করিতেছি, এই বার যেন তিনি সেই প্রতিটি নিষ্ঠুরতা নৃশংসতা ও অবমাননার শিকার হন, যাহা সন্তানদের প্রতি প্রয়োগ করিয়াছিলেন।’ এই নির্দিষ্ট মা ব্যতিক্রমী খল ও ক্রূর হইতে পারেন, কিন্তু সাধারণ মায়েরাও বহু সময়ে সন্তানকে মারিয়া ধরিয়া, ব্যঙ্গ করিয়া, অন্যের সহিত তুলনা টানিয়া নিরন্তর তাহাকে হীনম্মন্যতায় নিমজ্জিত করিয়া, তাহার আনন্দ-আয়োজনে দাঁত কিড়মিড়াইয়া বাধা প্রদান করিয়া, তাহার হৃদয়ে অসংখ্য শলাকা ফুটাইয়া দেন, বড় হইয়াও সে এই ক্ষতগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, বহু সময় সুস্থ জীবন যাপনে অপারগ হইয়া পড়ে। বহু মাতা নিশ্চয় খুবই ভাল, বহু মা তেমনই নিষ্ঠুর, ধর্ষকামী, সন্তানের প্রতি অমনোযোগী। আন্তর্জাল খুঁজিলে অনেক ব্লগ পাওয়া যাইবে, ‘আমি আমার সন্তানকে ঘৃণা করি’ মর্মে, এমন মায়েদের ‘গ্রুপ’ও মিলিবে। সকল সম্পর্কই আনন্দদায়ক হইতে পারে, দুঃখদায়কও হইতে পারে, মা ও সন্তানের সম্পর্কও ইহার বাহিরে নহে। কামু ‘আউটসাইডার’-এ এই সত্যটির রূপ উন্মোচিত করিয়া আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু সেই উপন্যাসে, সন্তান মায়ের মৃত্যুর প্রতি উদাসীন ছিল। মা সন্তানদের প্রতি নিতান্ত উদাসীন, তাহাদের ক্ষতি করিয়া আনন্দিত, এমন চরিত্রের দেখা সাহিত্যেও সহজে মিলে না। কিন্তু বাস্তবে মিলে। |