|
|
|
|
আপ-এর চাপে লোকপালে একসুর দু’পক্ষই
শঙ্খদীপ দাস ও দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি
১৪ ডিসেম্বর |
সরকার লোকপাল বিল আনলে পাল্টা অনাস্থা প্রস্তাব আনার হুমকি দিয়ে রেখেছেন মুলায়ম সিংহ যাদব। তবু সংসদে লোকপাল বিল পাশ করাতে কংগ্রেস সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা চালানোর বার্তা দিলেন রাহুল গাঁধী। সোমবার রাজ্যসভায় লোকপাল বিল নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। তার ৪৮ ঘণ্টা আগে আজ নাটকীয় ভাবে এ বিষয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন রাহুল। কংগ্রেস সহসভাপতি জানান, “জাতীয় স্বার্থে লোকপাল বিল পাশ করাতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ ব্যাপারে প্রায় সর্বসম্মতি গড়ে তুলতে পেরেছে কংগ্রেস। বাকি সব দল সমর্থন জানালেই বিলটি পাশ হয়ে যাবে।”
গত সাত-আট মাস ধরে প্রায় ঠান্ডা ঘরেই চলে গিয়েছিল এই লোকপাল বিল। শীত অধিবেশনে এসে রাতারাতি তার শীত ঘুম ভাঙাতে রাহুল কেন সক্রিয় হলেন সেটাই এখন কৌতূহলের বিষয় রাজনীতিকদের কাছে। রাহুলের সাংবাদিক বৈঠকেও আজ ঘুরেফিরে এই প্রশ্নটাই উঠে এসেছিল যে, কংগ্রেস কি তবে দিল্লির ভোটে আম আদমি পার্টির অলৌকিক উত্থানে ভয় পেয়ে গিয়েছে? স্বাভাবিক ভাবেই রাহুল তা উড়িয়ে দেওয়ারই চেষ্টা করেন যথাসাধ্য। তাঁর কথায়, “ব্যাপারটা তা নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কংগ্রেস সঙ্ঘবদ্ধ ভাবে লড়ছে। সে জন্য আগেই তথ্যের অধিকার বিল পাশ করিয়েছে সরকার। দল ও সরকার এ বার লোকপাল বিল পাশ করাতেও বদ্ধপরিকর।” |
পাশ করাবেন লোকপাল বিল। সাংবাদিক বৈঠকে দৃঢ় ঘোষণা রাহুল গাঁধীর। ছবি: এ এফপি |
তবে রাহুল যা-ই বলুন রাজনীতির বিশ্লেষকরা লোকপাল বিল তাঁর এই সক্রিয়তার নেপথ্যে অন্তত ৩টি কারণ দেখতে পাচ্ছেন। লোকপাল বিল পাশ করিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালদের রাজনৈতিক পরিসর দখল করতে চান রাহুল। দুর্নীতির কারণে সরকারের ওপর আস্থা হারিয়ে যাঁরা আপ-এর দিকে ঝুঁকেছেন, তাঁদের ফের কাছে টানতে চাইছেন তিনি। রাহুল এ-ও বোঝাতে চেয়েছেন, বিপর্যয়ের গ্লানিতে তিনি ঘরে ঢুকে যাননি। লোকসভা ভোটের মুখে ময়দান ছেড়ে যাওয়ারও কোনও প্রশ্ন নেই। বরং এখন থেকে আরও বেশি করে করে মুখ খুলবেন তিনি। বিধানসভা ভোটে বিপর্যয় নিয়ে কংগ্রেসের নেতা-কর্মীরা যখন পারস্পরিক দোষারোপে ব্যস্ত, তখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়টিকে সামনে রেখেই দলে ঐক্য ফেরাতে চাইছেন রাহুল। লোকসভা ভোটের আগে বিতর্কের প্রসঙ্গ ও অভিমুখও নির্দিষ্ট করে দিতে চাইছেন তিনি।
কংগ্রেস নেতারা বলছেন, এর পরেও বিজেপি লোকপাল বিল পাশ না হতে দিলে রাহুলের কাছে অস্ত্র মজুত থাকবে। তিনি বলতে পারবেন, কংগ্রেস চেয়েছিল, বাকিরা চায়নি।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিজেপি-ও কিন্তু আজ বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা এই বিলের পথে কাঁটা হবে না। রাহুলের সাংবাদিক বৈঠকের পরই সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দেন রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি। তাঁর বক্তব্য, “বিলটি নিয়ে ঢের আলোচনা হয়েছে। আর আলোচনার দরকার নেই। বিজেপি চায় রাজ্যসভায় দরকার হলে বিনা আলোচনায় পাশ হোক বিলটি। আমরা চাই, বিলটি নিয়ে সংসদীয় সিলেক্ট কমিটি যে ১৫টি সুপারিশ রেখেছে সরকার তা মেনে নিক।” ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতারাই জানাচ্ছেন, সরকার যে ১৪টা সুপারিশ মেনে নিতে প্রস্তুত ইতিমধ্যেই তা জেটলিকে জানিয়ে দিয়েছেন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কমলনাথ। জানিয়েছেন, লোকপালের আওতায় কেন্দ্রীয় ভিজিলেন্স কমিশন এবং সিবিআই-কে রাখতেও প্রস্তুত সরকার।
লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-র এই দরাজ মনোভাবও আজ কৌতূহল জাগিয়েছে যথেষ্ট। ঘরোয়া আলোচনায় বিজেপি নেতারা সেই ধোঁয়াশা কাটিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের কথায়, লোকপাল বিল এখন পাশ হয়ে যাওয়া এক দিক থেকে ভাল। নইলে ভবিষ্যতে বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাঁদেরও ভুগতে হবে। তা ছাড়া, বিলটি পাশ হলে লোকসভার ভোটের প্রচারে বিজেপি বলতে পারবে, কংগ্রেস দুর্বল লোকপাল তৈরি করেছে। বিজেপি ক্ষমতায় এলে তাকে আরও সবল করবে।
কিন্তু লোকপালে বিজেপি-র সমর্থনের সম্ভাবনার নেপথ্যে এ সবের ঊর্ধ্বেও যে একটা কারণ রয়েছে, তা-ও আজ গোপন থাকেনি। দলের অনেক নেতা এ-ও স্বীকার করছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষকে পুঁজি করে আম আদমি পার্টি যে ভাবে মাথা তুলেছে তা বিজেপি-কেও ভাবাচ্ছে। কারণ, বিজেপি-র জমিতেও তারা এখন থাবা বসাতে চাইছে। আর সেই কারণেই লোকপাল বিলে বাধা দিয়ে দোষের ভাগীদার হতে চায় না বিজেপি। মজার ব্যাপারে হল, গত প্রায় সাত বছর ধরে ঝুলিয়ে রেখে নরেন্দ্র মোদীও সম্প্রতি গুজরাতে লোকায়ুক্ত নিয়োগ করেছেন।
এ দিকে কেন্দ্রের সংশোধিত লোকপাল বিলে আজ সমর্থন জানিয়েছেন মহারাষ্ট্রের রালেগণ সিদ্ধীতে অনশনরত অণ্ণা হজারেও। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অণ্ণা আজ বলেন, “অনেক সময় চলে গিয়েছে বিতর্কে। সরকার যে লোকপাল বিল এনেছে সেটাই পাশ করানো হোক। পরে না হয় ফের সংশোধন করা যাবে।” একই মত জানিয়েছেন, অণ্ণার পুরনো সহযোগী কিরণ বেদীও।
সোমবার রাজ্যসভায় লোকপাল বিল হওয়ার আগে কংগ্রেস, বিজেপি, অণ্ণা এ ভাবেই আজ কার্যত এক পঙ্ক্তিতে এসে যাওয়ায় কিছুটা বিপাকে পড়ে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি আজ বলেন, “সরকারের আনা বিলটি লোকপাল নয়, জোকপাল।” এমনকী তিনি এ-ও বলেন, “অণ্ণাকে কারা ভুল বোঝাচ্ছেন জানি না।”
লোকপাল নিয়ে প্রধান দুই দলকে এ ভাবে একসুরে বলতে দেখে রাজনীতির পর্যবেক্ষকদের একাংশ আবার এমনও বলছেন যে, এটা হয়তো শত্রুর শত্রুকে বন্ধু করে নেওয়ার কৌশল। কংগ্রেস-বিজেপি উভয়ের কাছেই বিপদ হয়ে উঠেছে আম আদমি পার্টি। লোকসভা ভোটে রাহুল গাঁধীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রাথী দেওয়ার পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে খোদ কেজরিওয়ালই দাঁড়াবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন আপ নেতারা। এমনও হতে পারে, এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস-বিজেপ হাত মিলিয়ে তাদের অভিন্ন শত্রুকে বধ করতে চাইছে। এ কাজে আপ-এর সঙ্গে অণ্ণা হজারের বিরোধকেও তারা কাজে লাগাতে চাইছে সুকৌশলে।
কংগ্রেস অবশ্য আজ এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। এ-ও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, লোকপাল বিল পাশ করানোর কৃতিত্ব অণ্ণার সঙ্গে ভাগ করে নিতে মোটেই রাজি নন তিনি। অণ্ণার অনশন ভাঙাতে তিনি যাবেন কিনা প্রশ্ন করা হলে রাহুল এ দিন বলেন, “অণ্ণা তাঁর দৃষ্ঠিভঙ্গী নিয়ে কাজ করছেন। কংগ্রেস ও সরকার তাদের কাজ করছে।”
লোকপাল বিল পাশ করানো নিয়ে প্রশ্ন তবু রয়েই গেল। বস্তুত সমাজবাদী পার্টির সমর্থনেই কেন্দ্রে এখন টিকে রয়েছে সরকার। লোকপালে আপত্তি না থাকলেও মুলায়ম সিংহ এখনও বিলটির বিরোধিতা করে যাচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য, এই বিল পাশ হলে দেশে পুলিশ রাজ কায়েম হবে। বিজেপি-র সবজ সঙ্কেত পেয়েই সম্ভবত এই প্রথম মুলায়মের হুমকিকেও গ্রাহ্য করছে না কংগ্রেস। বরং রাহুলের পাশে বসে মুলায়মের হুমকি প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেছেন, “লোকপাল গঠন নিয়ে কারও আপত্তি নেই। কিছু ধারা নিয়ে কারও কারও আপত্তি রয়েছে।”
কিন্তু এর পরেও যদি মুলায়ম সোমবার রাজ্যসভায় গোল বাধান। এমনকী সরকারের ওপর থেকে সমর্থন তুলে নেন? জবাবে একাধিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, কে বলতে পারে, হয়তো সেই খেলাও রয়েছে তলায়-তলায়। তবে আজ অন্তত এটা পরিষ্কার যে দুর্নীতি দমন তথা লোকপাল বিল পাশ করানোর প্রত্যয় দেখিয়ে এখন ঘুরে দাঁড়াতে চাইছেন রাহুল গাঁধী। |
পুরনো খবর: লোকপাল পেশ হতেই হইচই, মুলতুবি রাজ্যসভা |
|
|
|
|
|