টিমের সঙ্গে সকালের প্র্যাক্টিস সেশন শেষে আজ আর এতটুকু সময় নষ্ট করেননি অভিমন্যু ঈশ্বরণ। বাড়ি ফিরে বসে পড়েছেন নিজের সঙ্গে, একা একা কথা বলতে। জানেন, শনিবার থেকে আগামী চার দিন যে চ্যালেঞ্জটা আসছে, তা তাঁর উনিশ বছরের ক্রিকেটজীবনের কঠিন নয়। কঠিনতম। ইডেনের সবুজ পিচ। পুরো পয়েন্ট চাই। উল্টো দিকে আবার উত্তরের এমন সব সিমার, যাঁদের দেখলে গ্রিন টপে শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নামবে আপনাআপনি।
তুকতাক করছেন? প্রার্থনা?
রাতে ফোনে প্রশ্নটা শুনে হেসে ফেলেন বঙ্গ ক্রিকেটের পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান ব্যাটসম্যান। অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসে বলে দেন, “কাল ইডেনকে প্রণাম করে ঢুকে পড়ব। মন বলছে, আমি পারব। ঠিক রান করব!”
শনিবার ওপেন করতে হতে পারে বলে আজ আর বাড়িই ফিরলেন না কৌশিক ঘোষ। তাঁর বর্তমান অস্থায়ী বাস্তুভিটে সিএবি ডরমেটরি। অরিন্দম দাস সুস্থ হয়ে উঠলে ভাল, নইলে তিনি। কিছু ভাবলেন? তুরীয় মেজাজে উত্তর, “যা ভাবার ভেবেছি। এখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, রাতে ঘুম। মাঠে নেমে বাকিটা।”
মনে মনে সারা দিন একটা ক্রিকেটীয় তত্ত্ব মুখস্থ করে চলেছেন ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায়। শনিবার থেকে সব চলতে পারে, কিন্তু লুজ শট নয়। “আসলে কী জানেন, জীবনের সবচেয়ে বড় মুহূর্ত এটা। কোনও ভুল করতে চাই না। যে ভাবে ক্লাব ম্যাচ খেলি, সে ভাবে খেললেই হবে।” |
রঞ্জি ট্রফিতে এই মুহূর্তে যে সন্ধিক্ষণের মুখোমুখি বাংলা, তাতে স্বাভাবিক দিক থেকে ওই তিন কেন, এক জনের নামও উচ্চারিত হওয়ার কথা নয়। মহম্মদ কাইফ-পীযুষ চাওলার উত্তরপ্রদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ঘরের মাঠে গ্রিন টপ বানিয়ে প্রাক্তন জাতীয় পেসার বেঙ্কটেশ প্রসাদের (উত্তরের তিনিই কোচ কিনা) গেমপ্ল্যানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অথচ রঞ্জি ট্রফিতে সঞ্জীবনী মন্ত্র যদি খুঁজতে হয়, তা হলে আসন্ন যুদ্ধ থেকে তিন-টিন না, চাই সোজা ছ’পয়েন্ট। বোধবুদ্ধি বলে, এ সব ম্যাচে থাকবেন সিনিয়ররা। সামলে দেবেন। কিন্তু তাঁরা পরের পর খারাপ পারফরম্যান্সে বাদ, এবং বাংলা সম্মুখীন এমন এক পরিস্থিতির, যা সাম্প্রতিকে ঘটেনি।
সিনিয়র কম। কেউ উনিশ। কেউ একুশ। কেউ বাইশ। এবং তিন জন রঞ্জিতে প্রথম বার! কারা? কেন, উপরের তিন ব্যাটসম্যান। অভিমন্যু, ঋত্বিক ও কৌশিক। লোকে এমনি বলাবলি করছে যে, ম্যাচটা মোটেও শুধু বাংলা বনাম উত্তরপ্রদেশ রঞ্জি নয়, বরং ‘গেম অব গ্যাম্বলস’ বেশি!
সহজ বাংলায়, বাংলার ফাটকা।
ফাটকা কারণ, ঘরের মাঠের সবুজ পিচ। যার কিনা অতীতে ঘরের টিমের বিরুদ্ধেই যাওয়ার উদাহরণ আছে। ফাটকা কারণ, এমনি পিচে বঙ্গ ব্যাটসম্যানদের মহড়া নিতে হবে প্রাক্তন ভারতীয় পেসার আরপি সিংহ, ইমতিয়াজ আলি, অমিত মিশ্রদের (ইনি পেসার)। ফাটকা কারণ, ছ’পয়েন্ট তোলার ম্যাচে বাংলার হাতে পাঁচ থেকে ছ’জন জুনিয়র।
মহম্মদ কাইফ।
বিপক্ষের নক্ষত্র। |
গীতিময় বসু, অরিন্দম না খেললে কৌশিক, ঈশ্বরণ, ঋত্বিক, সায়নশেখর মণ্ডল, সন্দীপন দাস। কোচ অশোক মলহোত্রকে জিজ্ঞেস করা হলে বললেন, “জানি, গ্যাম্বল। কিন্তু উপায় নেই।” টিম উত্তরপ্রদেশের ধরনধারণ দেখলে ভয়টা আরও বাড়বে। টিমটা এমনিতেই ৫ ম্যাচে ২০ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ শীর্ষে। কাইফকে দেখা গেল বেশ ফুরফুরে। সিএবি-র ‘বদান্যতায়’ বাস-সঙ্কট নিয়ে চিন্তা কম, প্রিয় ‘দাদা’ মাঠে আসবেন কি না, তা নিয়ে ভাবনা বেশি। বেঙ্কটেশ প্রসাদ ছুটছেন ইডেনের কোথায় তাঁর দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে টেস্টে ছ’উইকেট নেওয়ার ব্যাপারটা লেখা আছে, দেখতে। দেখতে গিয়ে আবার জাভাগল শ্রীনাথের নামের ভুল বানান শুধরে দিচ্ছেন। পরে প্রসাদ বলছিলেন, “এমন উইকেটই দরকার। আরপি এ বার পাঁচ উইকেট পায়নি। কে বলতে পারে, এখানেই...।”
এবং এখানেই থামিয়ে দিচ্ছেন লক্ষ্মীরতন শুক্ল!
“আপনারা কী বলছেন এটা? কীসের জুয়া খেলছি? জুনিয়র নিয়ে এত আতঙ্ক তো, বলছেন তো যুদ্ধটা শুধু আমি বনাম ইউপি, শুনে রাখুন এদের বয়সে আমিও এত ট্যালেন্টেড ছিলাম না,” সন্ধেয় ঝাঁঝিয়ে ওঠেন বাংলা অধিনায়ক। একটু থেমে ইডেন পার করে দেওয়া ‘ক্লিন-হিট’, “দেখবেন, ঘাসের উইকেটে আমরা ম্যাচ বার করব। দেখবেন, এই ম্যাচ থেকেই এমন ক্রিকেটার জন্ম নেবে যে দশ বছর বাংলাকে টানবে। আর আমি কে? টিমে সবাই আমার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিভাবান। সবাই।”
অন্ধকার নয়, লক্ষ্মী উত্তরপ্রদেশ ম্যাচে বঙ্গ ক্রিকেটের নতুন ব্রাহ্মমুহূর্ত দেখছেন। চাইছেন আগামী দু’টো ম্যাচে মন দিয়ে ক্রিকেট, যা এখনও তাঁর টিমকে কোয়ার্টারে তুলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট! ঈশ্বরণ-সায়নশেখরদের নতুন প্রজন্মের কাছে কোনও দিন স্টাইল-আইকন হবেন না, মধ্যবিত্ত নায়ক থাকবেন, কিন্তু পাল্টা যুদ্ধের বারুদ গুঁজে যাবেন নির্বিচারে। আজও। বাংলার সংসারে আঠারো বছর কাটিয়ে দেওয়ার পরেও। যাঁর কথা স্বপ্নের মতো শোনাবে। আবার তিনি বললে, চরম পরিস্থিতিতেও স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করবে।
যতই হোক, রাজ্যই লক্ষ্মীরতন শুক্ল-র দেশ। বাংলাই তাঁর কাছে ভারতবর্ষ! |
বাংলার সংসারে |
• কোয়ার্টার ফাইনালের সম্ভাবনা বাঁচিয়ে রাখতে এই ম্যাচে দরকার পুরো ৬ পয়েন্ট।
• টিমে সিনিয়র কম, জুনিয়র বেশি।
• জুনিয়রদের মধ্যে অভিষেক সম্ভবত তিন জনের। যাঁদের বাংলা ক্যাপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে দীপ দাশগুপ্ত, দেবাঙ্গ গাঁধী ও রোহন গাওস্করের হাত দিয়ে।
• ওপেনার অরিন্দম দাস পিঠের ব্যথ্যায় এখনও অনিশ্চিত।
• সবুজ পিচ। যা বাংলার বিরুদ্ধে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে।
• প্রধান চিন্তা মহম্মদ কাইফ ও রুদ্রপ্রতাপ সিংহ। |
|