|
|
|
|
|
ভর্তির কেস? ট্রলি
ঠেলে নিয়ে চলে যান
বরুণ দে • মেদিনীপুর |
|
ঘড়ির কাঁটা রাত ৯টা ২০ ছুঁয়েছে।
বুকে ব্যথা নিয়ে জরুরি বিভাগে এলেন কেশপুরের আনিমান বিবি। বয়স আশি ছুঁইছুঁই।
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে তখন এক জন সিনিয়র, এক জন জুনিয়র ডাক্তার। তাঁরা অবস্থা দেখে ভর্তি করতে বললেন।
কিন্তু ওয়ার্ডে নিয়ে যাবে কে?
বুধবার রাতে তখন চিকিৎসকেরা ছাড়া আছেন দুই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। অন্য একটি ঘরে দু’জন নার্স রোগীর নাম-ঠিকানা খাতায় তুলছেন। জরুরি বিভাগের সামনে রাখা তিনটি ট্রলি। তারই একটি বৃদ্ধার পরিজনদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মী ‘ভর্তির কেস? যান, ফিমেল ওয়ার্ডে নিয়ে চলে যান। চেনেন তো? ওই যে সামনে বড় বিল্ডিংয়ে...।’
আর কথা না-বাড়িয়ে ট্রলি ঠেলে বৃদ্ধাকে নিয়ে গেলেন পরিজনেরাই। যাওয়ার আগে জরুরি বিভাগে রেখে যেতে হল দু’টি টিকিট, যা রোগীর পরিজনদের কাছেই থাকার কথা। একটি হলুদ, অন্যটি লাল। হলুদ রঙের টিকিট নিয়ে রোগীর সঙ্গে সব সময়ে এক জন থাকতে পারেন। লাল টিকিট দেখিয়ে ‘ভিজিটিং আওয়ারে’ ওয়ার্ডে ঢোকা যায়।
কেন টিকিট জমা রাখতে হল? ‘আরে, ওটাই ট্রলি নিয়ে যাওয়ার জামানত!’ তিক্ত গলায় বলে ওঠেন এক ভুক্তভোগী। সঙ্গে টিকিট দিয়ে দিলে যদি রোগীর পরিজনেরা ওয়ার্ডে রোগী পৌঁছে দেওয়ার পরে ট্রলিটি আর জরুরি বিভাগে ফিরিয়ে দিয়ে না যান? ১৫০-২০০ মিটার পথ উজিয়ে তা আনতে যাবে কে? তাই রোগীর পরিজনেরা এসে ট্রলি ফেরত দিলে তবেই তাঁদের টিকিট ফেরত দেওয়া হয়। তার আগে নয়। এটাই মেদিনীপুর মেডিক্যালের রোজনামচা। |
রাত ৯টা ২১
পরিজনদেরই গাড়ি থেকে
নামাতে হচ্ছে রোগীকে। |
রাত ১০টা ৫মিনিট
এক জন সিনিয়র ও এক জন জুনিয়র
ডাক্তারের উপরেই ইমার্জেন্সির ভার। |
|
আনিমান বিবির সঙ্গে এসেছিলেন শেখ জুরাস। তাঁর প্রশ্ন, “রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কি পরিজনদের? তা-ও ট্রলি ফেরত না দিলে টিকিট আটকে রাখা হবে। এ কী নিয়ম?” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, কর্মীর সংখ্যা দরকারের তুলনায় কম। যেখানে ১৬৭ জন থাকার কথা, আছেন মোটে ৮৬ জন। মেদিনীপুর মেডিক্যালের পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান তথা বিধায়ক মৃগেন মাইতির অবশ্য বলেন, “পরিজনরা রোগীকে নিয়ে ওয়ার্ডে যাবেন কেন? কর্মীদেরই তো পৌঁছে দেওয়ার কথা।” হাসপাতাল সুপার যুগল করের দাবি, “সব ক্ষেত্রেই যে পরিজনেরা রোগীকে ট্রলিতে করে নিয়ে যান, এমনটা নয়। কর্মীরাও নিয়ে যান। ”
বুধবার রাত সওয়া ৮টা থেকে সওয়া ১১টা এই তিন ঘণ্টায় যত রোগী জরুরি বিভাগে এসেছেন, সকলেরই পরিজনদের কিন্তু ওয়ার্ড পর্যন্ত ট্রলি ঠেলতে হয়েছে। রাত ৮টার কিছু পরে জ্বর নিয়ে এসেছিলেন নির্মল জানা। চিকিৎসক ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। ট্রলি ঠেলে তাঁকে নিয়ে যান সঙ্গে আসা শান্তিনাথ মাইতি। জরুরি বিভাগে সব মিলিয়ে ১০টি ট্রলি রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র দু’টিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় কোনও রোগী এলে ট্রলি পেতে হিমশিম খেতে হয়। হুইল চেয়ার আছে মোটে তিনটি। সুপারের আশ্বাস, “নতুন ট্রলি কেনার ব্যবস্থা হচ্ছে।” |
রাত ১১ টা
একজন এনভিএফ কর্মীর ঘাড়েই
গোটা চত্বরের নিরাপত্তার ভার। |
রাত ১১ টা ১০
১২ শয্যার ইমার্জেন্সি অবজারভেশন
ওয়ার্ড রয়েছে। দেখা নেই রোগীর। |
|
জরুরি বিভাগের পাশেই রয়েছে ১২ শয্যার অবজারভেশন ওয়ার্ড। সাধারণত, কোনও রোগী জরুরি বিভাগে এলে তাঁকে প্রথমে সেখানেই ভর্তি রাখার কথা। পরে পরিস্থিতি বুঝে অন্য ওয়ার্ডে পাঠানো হতে পারে। অবস্থার উন্নতি হলে সেখান থেকে ছুটিও দেওয়া যায়। বাস্তবে অবশ্য এমনটা হয় না। ওয়ার্ডটি চালু রয়েছে শুধু খাতায়-কলমে। কলকাতা থেকে স্বাস্থ্য দফতরের কর্মকর্তারা এলে আগেভাগে কয়েক জন রোগী সেখানে রাখা হয়। কর্তারা দেখে-শুনে ফিরে গেলে যে কে সেই! এখন সেখানে সারি দিয়ে ফাঁকা খাট পাতা। মাঝখানে সাইকেল রাখা। মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তমালকান্তি ঘোষ অবশ্য দাবি করেন, “আমি কয়েক দিন আগে ওই ওয়ার্ডে গিয়েছিলাম। কয়েক জন তো ভর্তি ছিলেন!” হাসপাতালের অন্য এক আধিকারিক বলেন, কর্মী কম থাকাতেই ওয়ার্ডটি চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
মেদিনীপুর মেডিক্যালে এখন শয্যা রয়েছে সব মিলিয়ে ৫৬০টি। গড়ে ভর্তি থাকেন ৭০০-৭৫০ জন। নভেম্বরে শুধু বহির্বিভাগেই এসেছেন ১৫৮৯৭ জন। অর্থাৎ, দিনে গড়ে ৫৩০ জন। জরুরি বিভাগে এসেছেন ৬৫৬৯ জন। দিনে গড়ে ২২০ জন, অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৯-১০ জন। জরুরি বিভাগে মাত্র এক জন সিনিয়র ও এক জুনিয়র ডাক্তার থাকায় অনেক সময়েই রোগীর চাপ সামলাতে তাঁদের হিমশিম খেতে হয়। দুর্ঘটনাগ্রস্তদের প্রাথমিক ড্রেসিংও চতুর্থ শ্রেণির কর্মীরাই করেন বলে অভিযোগ। পর্যাপ্ত নিরাপত্তাও নেই। জরুরি বিভাগের সামনে থাকেন দু’জন এনভিএফ কর্মী। হাসপাতালের অন্যত্র মাত্র ৬ জন। ক্যাম্পাসে পুলিশ-ফাঁড়ি নেই। বড় দু’টি গেটের কাছে চেক পোস্টও নেই। কেন? পরিচালন সমিতির চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন, “শীঘ্রই হাসপাতালের দু’দিকে চেক পোস্ট তৈরি হবে। রাতেও নজরদারি চলবে।”
রোগটা কী সকলেরই জানা। কিন্তু সারাবে কে? কবে?
|
ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল। |
|
|
|
|
|