লগ্নি সংস্থা বিল পাশ,
এ বারই হেস্তনেস্ত চেয়ে দিল্লিকে বার্তা

ইনের ভাষা বা এক্তিয়ারের প্রশ্নে বিগত দশ বছর ধরে টালবাহানা চলেছে। তবু আইন তৈরি করা যায়নি। কেন্দ্রের প্রস্তাবমতো আরও এক বার অর্থ লগ্নি সংস্থার হাতে প্রতারিত আমানতকারীদের স্বার্থরক্ষায় বিল পাশ হল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়, চার দফা সংশোধনী-সহ।
এবং বৃহস্পতিবার নতুন বিলটি পেশ করে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, এই টানাপোড়েনে রাজ্য সরকার বীতশ্রদ্ধ। এ বার তাঁরা শেষ দেখতে চান। “অনেক হয়েছে। আর নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে চিঠি লিখে বলেছি, আপনারা নিত্যনতুন পরামর্শ দেবেন, আর আমরা বার বার বিধানসভায় নতুন করে বিল আনব এটা চলতে পারে না। বারংবার আলোচনার পরে এই বিল পেশ করা হল। আমাদের বিচারে এটাই সংহত, সম্পূর্ণ এবং শেষ বার পেশ করা বিল।” এ দিন সভায় বললেন অমিতবাবু।
এতেই তিনি থেমে যাননি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে লেখা চিঠির অংশবিশেষও সভায় পড়ে শুনিয়েছেন। যাতে বলা হয়েছে, ‘আইনি পরিভাষা নিয়ে কেন্দ্রের তরফে অযথা কচকচির জন্য ইতিমধ্যে বিস্তর দেরি হয়ে গিয়েছে। তাতে আখেরে সাধারণ মানুষই বিচারে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটিকেই শেষ বারের মতো পেশ করা বিল ধরে নিয়ে দিল্লি যেন দ্রুত তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেয়।’
অর্থমন্ত্রীর আগে বিল-বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র একই আশঙ্কার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁর মন্তব্য, “দিল্লিতে অনেক পাকা মাথা কাজ করছে। তাঁরা কোনও ভাবেই চান না, এই বিল পাশ হোক। আমাদেরও এই আইন পাশ করানো নিয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাতে ভর করেই বলছি, আরও এক বার হয়তো বা কেন্দ্রীয় সরকারের ফাঁদে পা দিতে চলেছে সরকার।” বিরোধী দলনেতার দাবি: গত এপ্রিলে পাশ হওয়া বিলটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতির কোনও মতামত আসার আগেই রাজ্য সরকার যে ভাবে তা প্রত্যাহার করে নিল এবং এ দিন নতুন ভাবে বিল পেশ করল, তার কোনওটাই সংবিধানসম্মত নয়।
বস্তুত এই যুক্তিতে দিল্লি এটাও নাকচ করে দিতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। সূর্যবাবু বা তাঁর দল বিলটির সরাসরি বিরোধিতা না-কলেও ওঁদের বক্তব্য: ফৌজদারি বিধি অনুযায়ী কোনও আইন হওয়ার পরে কিছু ঘটলে নতুন আইনেই তার বিচার হওয়ার কথা। আগের ঘটনার বিচার নতুন আইনে করা যায় না। অর্থাৎ, ‘রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্ট’ দেওয়া যায় না। অথচ নতুন বিলে যে ভাবে প্রসঙ্গটির অবতারণা হয়েছে, কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রক তা মানতে না-ও পারে বলে বিরোধী দলনেতা মনে করছেন। এই সম্ভাব্য বাধা এড়াতে তিনি এ দিন কয়েকটি সংশোধনীও আনেন। যদিও সরকার তার একটাও মানেনি।
অন্য দিকে অমিতবাবু বিরোধী দলনেতার সংশয় নস্যাৎ করে দিয়েছেন। সভায় অর্থমন্ত্রী জানান, বিলটি পেশ করার আগে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, তারা এর সাংবিধানিক বৈধতা মেনে নিয়েছে। অর্থমন্ত্রীর দাবি: তামিলনাডুতে একই ধরনের বিল পেশ হয়েছিল, যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। শীর্ষ আদালত শেষমেশ তাকে মান্যতা দিয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গের বিলটিও তামিলনাডুর ধাঁচে তৈরি, তাই দিল্লি এটিকেও সংবিধানসম্মত মনে করছে। অর্থমন্ত্রীর এ-ও দাবি: অন্যান্য কেন্দ্রীয় আইনের সঙ্গে রাজ্যের প্রস্তাবিত আইনের পরস্পর-বিরোধিতা প্রসঙ্গে কেন্দ্র বলেছে, অর্থ লগ্নি সংস্থা নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত সেবি-আইনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিলের কোনও বিরোধ নেই। তবু যেটুকু ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ ছিল, সংশোধনীর মাধ্যমে তা দূর করা হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যের বিভিন্ন আইনের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য প্রসঙ্গে দিল্লি বলেছে, ১৫টি রাজ্য ও দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে এমন বিল আগেই পাশ হয়েছে।
অর্থাৎ, সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্নে যে কোনও সমস্যা হবে না, সে ব্যাপারে দিল্লির আশ্বাস মিলেছে বলে সভায় দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “বাম জমানায় কেন্দ্র কখনও মূল প্রশ্নগুলোয় রাজ্যকে পুরোপুরি রেহাই (ক্লিন চিট) দেয়নি। এ বার তা হবে না। ২০০৩ থেকে কেন্দ্রের সঙ্গে দরাদরি চলেছে। এ বারই প্রথম কেন্দ্র-রাজ্য বেশ কিছু বিষয়ে সম্মত হওয়ায় বিলটি শক্তিশালী হয়েছে।”
অর্থ দফতর-সূত্রের খবর: অর্থ লগ্নি সংস্থায় টাকা রেখে প্রতারিতদের স্বার্থরক্ষায় ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রোটেকশন অব ইন্টারেস্ট অব ডিপোজিটর্স ইন ফিনান্সিয়াল এস্টাব্লিশমেন্ট বিল’ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় প্রথম পাশ হয় ২০০৩-এ। কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক তা নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন তোলে। সে সব পাশ কাটিয়ে ২০০৮-এ ফের বিধানসভায় বিল পেশ হয়। আগের বিল রাষ্ট্রপতির কাছে পড়ে থাকা অবস্থায় নতুন বিল আনার যৌক্তিকতা সম্পর্কে তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন তৎকালীন তৃণমূল বিধায়ক সৌগত রায়। এরই মধ্যে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল পুরনো বিল ফেরত পাঠিয়ে দিলে নতুন বিলটি ২০০৯-এ বিধানসভায় পাশ করে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠায় রাজ্য। তা অবশ্য সেখানে পড়েই থাকে। ২০১৩-য় পশ্চিমবঙ্গে অর্থ লগ্নি-কেলেঙ্কারি সামনে আসার পরে ফের তৎপরতা শুরু হয়। কেন্দ্র ২০০৯-এর বিল ফেরত পাঠায়। ২০১৩-র ১৩ এপ্রিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার নতুন বিল আনে, ফিরিয়ে নেওয়া হয় বাম জমানার বিল।
কিন্তু অমিত মিত্রের পেশ করা ওই বিল সম্পর্কেও সাত দফা প্রশ্ন তুলেছিল অর্থ মন্ত্রকের বিভিন্ন বিভাগ। দফায় দফায় আলোচনা চালিয়ে শেষমেশ চারটি সংশোধনী-সহ এ দিন আবার বিল পেশ করা হয়েছে। ফিরিয়ে নেওয়া হয় গত ১৩ এপ্রিলের বিলটি।
এই বিল পেশের বিতর্ককে কেন্দ্র করেই এ দিন বার বার উঠে এসেছে সারদা কেলেঙ্কারির সঙ্গে শাসকদলের যোগাযোগের অভিযোগ এবং তা নিয়ে তদন্তের প্রসঙ্গ। এসইউসিআই বিধায়ক তরুণ নস্করের প্রশ্ন, “এপ্রিলে মুখ্যমন্ত্রী অর্থ লগ্নি সংস্থার মালিকদের সঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী-সহ আগের জমানার অনেক নেতা-নেত্রীর ছবি দেখিয়েছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হল না কেন? গ্রেফতার হওয়া সাংসদ যাঁদের নাম করেছেন, তাঁরাও কি সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে?” শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, “যাঁরা এত চিৎকার করছেন, তাঁরা কত পেয়েছেন, সময় হলেই সে সব বেরিয়ে যাবে। আর মুখ খোলাবেন না!”
শিল্পমন্ত্রীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে বিরোধী দলনেতার পাল্টা চ্যালেঞ্জ, “হোক না সিবিআই-তদন্ত! আমার দলের যে কোনও মাপের নেতা জড়িয়ে থাকলে সিবিআই তাঁদের ধরুক। শাসকদলের কেউ জড়িয়ে থাকলে তাঁরাও তদন্তের সামনাসামনি হোন।” এর জবাব আবার দিয়েছেন সরকারপক্ষের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। ২০০৯-এর ১৯ মার্চের বিধানসভা-কার্যবিবরণী উদ্ধৃত করে তিনি জানিয়েছেন, রাজ্য জুড়ে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার প্রসঙ্গে সিবিআই-তদন্ত চাওয়ায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘সিবিআই-কে দায়িত্ব দেওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। সিবিআই-কে আপনারা মনে করতে পারেন ভগবান, দেবদূত। আমরা করি না।’ এর প্রেক্ষাপটে এখন বিরোধীদের উদ্দেশে শোভনদেববাবুর প্রশ্ন, “তা হলে এখন কেন সিবিআই চাইছেন? আপনারা তো তাদের ভগবান মনে করেন না!”
অর্থমন্ত্রী অবশ্য জবাবি ভাষণে কেলেঙ্কারির তদন্ত প্রসঙ্গে একটা কথাও বলেননি। শুধু বলেছেন, গরিব আমানতকারীদের টাকা ফেরাতে শ্যামল সেন কমিশন কাজ করছে। ইতিমধ্যে ১৬৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সব মিলিয়ে ২ লক্ষ ৮৭ হাজার আমানতকারী হয় টাকা পেয়েছেন, কিংবা পেয়ে যাবেন। আইন পাশ হলে এই জাতীয় সংস্থার কাজকর্মে রাশ টানা আরও সহজ হবে বলে জবাবি বক্তৃতায় আশা প্রকাশ করেছেন অমিতবাবু।

চার সংশোধনী
নির্দিষ্ট সময়ে টাকা ফেরাতে বা অন্য প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত।
সব অর্থ লগ্নি সংস্থা রাজ্যকে ব্যবসার যাবতীয় তথ্য দিতে বাধ্য। না-দিলে তিন মাসের জেল বা হাজার টাকা জরিমানা। ওই তথ্য যাবে সেবি, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ও রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ-এ।
আমানতকারীর টাকা অসদুদ্দেশ্যে সরালে কিংবা তা দিয়ে সম্পত্তি কিনলে সরকার সেই অর্থ-সম্পত্তি খুঁজে বাজেয়াপ্ত করবে।
অভিযুক্ত সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়া ব্যক্তি বা সংস্থার অর্থ-সম্পত্তিও বাজেয়াপ্ত করা যাবে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.