সকাল তখন ১০টা। হুগলি জেলা সদর চুঁচুড়ার ব্যস্ততম এলাকা হাসপাতাল চত্বর লোকে লোকারণ্য। স্কুল-কলেজে চলেছে পড়ুয়ারা। অফিস যাত্রীরাও বেরিয়ে পড়েছেন বাড়ি থেকে। শীতের সকালের রোদ মেখে দোকান-বাজারে কেনাকাটাও সবে শুরু হল। হঠাৎই ছন্দ পতন।
শহরের মধ্যে দিয়ে সাত-আটটি বাইকে বেশ কিছু যুবক হইহই করতে করতে গিয়ে চড়াও হল থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে তৃণমূলের পার্টি অফিসে। ভাঙচুর চলল সেখানে। শাসক দলের কর্মীরা তখনও কেউ এসে পৌঁছননি কার্যালয়ে। অবাধে ভাঙচুর চলল সেখানে। খবর পেয়ে হাজির হয়েছিল চুঁচুড়া পুরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর জয়দেব অধিকারীকে। তারপর হাল্কা মেজাজে শিস দিতে দিতেই এলাকা ছাড়ল হামলাকারীরা। অভিযোগ, সকলেই সিপিএম কর্মী-সমর্থক। |
কয়েক মিনিটের মধ্যেই চিত্রটা উল্টে গেল। হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে জনা পনেরো লোক রে রে করে অদূরেই সিপিএমের একটি কার্যালয়ে চড়াও হল। তাদের রুদ্রমূর্তি দেখে এলাকার লোকজন যে যে দিকে পারে দৌড় দিল। সিপিএমের অফিসেও লোকজন তেমন ছিল না। অবাধে ভাঙচুর চলল। হাতের কাছে পেয়ে মারধর করা হল সিপিএম সমর্থক সমীর রজককে। অভিযোগ, হামলাকারীরা সকলেই তৃণমূল কর্মী-সমর্থক।
বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে ঘণ্টা খানেক ধরে এই তাণ্ডবের সাক্ষী থাকলেন শহরবাসী। যদিও ঘটনাস্থল থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে থানা থেকে কোনও পুলিশ কর্মীকে হাজির হতে দেখা যায়নি গোলমাল চলাকালীন। সব কিছু মিটে গেলে এল পুলিশ। তদন্ত শুরু হয়েছে বলে রুটিন মাফিক জানালেন পুলিশ কর্তারা। যদিও ধরপাকড় কিছুই হয়নি রাত পর্যন্ত। সময় মতো পুলিশ এল না কেন? সদুত্তর মেলেনি পুলিশের কাছে।
বস্তুত, এ দিন ভোর থেকেই এলাকায় উত্তেজনা দানা বাঁধছিল। ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের রথতলায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দেওয়া বেশ কিছু পোস্টার ছেঁড়া অবস্থায় দেখা যায়। ক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা অভিযোগ জানান থানায়। যখন তাঁরা পুলিশের সঙ্গে কথা বলছেন, সেই সুযোগেই তাঁদের দলীয় কার্যালয়ে হামলা চলে।
চুঁচুড়ার বিধায়ক, তৃণমূল নেতা তপন মজুমদার বলেন, “সিপিএমের হার্মাদবাহিনী রাতের অন্ধকারে ধারাল অস্ত্র দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি লাগানো হোর্ডিং ছিঁড়ে ফালাফালা করে দেয়। এলাকার সব ক’টি হোর্ডিং ওরা নষ্ট করে দিয়েছে। আবার বিনা প্ররোচনায় আমাদের পার্টি অফিসে হামলা করল।” প্রহৃত তৃণমূল কাউন্সিলর জয়দেববাবুর দাবি, “আমরা যখন থানায় অভিযোগ জানাতে গিয়েছি, কিছু যুবক ওদের অফিসে হামলা করে। হামলাকারীদের পরিচয় আমার জানা নেই।”
অন্য দিকে, স্থানীয় সিপিএম নেতা তথা দলের জোনাল কমিটির সদস্য অরিন্দম ভট্টাচার্যের পাল্টা বক্তব্য, “হোর্ডিং ছেড়ার সঙ্গে আমাদের দলের কেউ যুক্ত নয়। উন্মত্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই আমাদের দলীয় কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে।” তিনি দাবি করেন, “তৃণমূলের অফিসে যারা হামলা করেছে, তারা আমাদের কেউ নয়।” |
দিনেদুপুরে জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে লাঠিসোঁটা, বাঁশ হাতে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দাপিয়ে বেড়াতে দেখে আতঙ্ক ছড়িয়েছে এলাকায়। কাছেই পুলিশ সুপারের অফিস এবং চুঁচুড়া থানা। পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী শুধু বলেন, “দু’পক্ষই থানায় অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ দায়ের করেছে। তদন্ত শুরু হয়েছে। দোষীদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।”
সম্প্রতি হুগলিতে একের পর এক ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তাঁদের বক্তব্য, এলাকার রাশ পুলিশের হাতে না থাকার কারণেই একদিকে সমাজবিরোধী দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলিতে সমাজবিরোধীরা ঢুকে পড়ায় দফায় দফায় নিয়ম করে প্রতিদিনই গণ্ডগোল বাধছে। পুলিশ ঠেকাতে পারছে না।
কয়েক দিন আগেই এক সন্ধ্যায় হুগলি স্টেশন বাজার এলাকায় ভরা বাজারের মধ্যে এলোপাথাড়ি গুলি ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। এক জনের মৃত্যু হয় ওই ঘটনায়। এক ছাত্রী-সহ কয়েক জন জখম হন। ওই ঘটনায় মৃতের পরিচয় এখনও পর্যন্ত জানাতে পারেনি হুগলি জেলা পুলিশ। ভদ্রেশ্বরেও ভরা বাজারে সন্ধ্যায় এক ব্যবসায়ীকে দোকানে ঢুকে গুলি করে সমাজবিরোধীরা। ওই ব্যবসায়ীর ভাই নৃশংস ভাবে খুন হয়েছিলেন। সেই মামলায় ওই ব্যবসায়ী প্রধান সাক্ষী। সে কারণেই তাঁর উপরে হামলা চলে বলে অভিযোগ। ব
ব্যান্ডেলেও দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য কমছে না বলে স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ। |
সিপিএমের হার্মাদবাহিনী রাতের অন্ধকারে
দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ছবি লাগানো হোর্ডিং ছিঁড়ে
দেয়। বিনা প্ররোচনায় আমাদের পার্টি
অফিসে হামলা চালায়।
তপন মজুমদার, তৃণমূল বিধায়ক |
হোর্ডিং ছেঁড়ায় আমাদের দলের কেউ
যুক্ত নয়। উন্মত্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই এ দিন আমাদের
দলের কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছে।
অরিন্দম ভট্টাচার্য, সিপিএমের জোনাল সদস্য |
|
তোলাবাজদের দাদাগিরিতে তটস্থ ব্যবসায়ীরা সম্প্রতি এলাকায় বৈঠক পর্যন্ত করেন। সেখানে পুলিশের একাংশের সঙ্গে সমাজবিরোধীদের ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ তোলেন শাসক দলেরই এক বিধায়ক। এক পদস্থ পুলিশ কর্তার বক্তব্য, ‘‘বিষয়টি দেখা হবে। দুষ্কৃতীদের যারা মদত দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধেও পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। তারা রাজনীতির লোক হলেও ছাড় পাবে না।’’
|