প্রবন্ধ...
আনন্দ কেবল সন্তান উৎপাদনের জন্য
ইনের ধারা বদল করা আদালতের কাজ নয়, প্রচলিত আইনকে ব্যাখ্যা করা ও তার সাংবিধানিকতা যাচাই করাই এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। আইন পালটানো নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাজ। ভোটমুখী রক্ষণশীল ধর্মবাদী দল বা ভোটমুখী ধর্মবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এই জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ সমকামীদের জন্য সংসদে আইন বদলের জন্য কতটা সচেষ্ট হবেন, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। জনপ্রতিনিধিরা জনমতের প্রতিনিধিও বটেন। সব আইনের সব ধারায় না হোক, কোনও কোনও আইনের কোনও কোনও ধারায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভঙ্গির প্রতিফলন ঘটে। যৌন-সংসর্গ বিষয়ে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সম্ভবত এখনও যে নীতিকে মান্য করেন, সেই নীতি ‘প্রকৃতি অনুসারী’ ও ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বলতে কী বোঝায়, তা নিয়ে বিশেষ একটা হিসেব কষে রেখেছে। সেই হিসেব এক দিনে গড়ে ওঠেনি। সমকামীদের সমর্থনে সংগত কারণে যাঁরা আন্দোলনরত, তাঁদের সংবিধানের অন্তর্গত এই ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ শব্দটির মানে আলাদা করে জানতে হবে। তা হলে তাঁরা বুঝতে পারবেন, কেন তাঁদের ব্যক্তিগত যৌন অভিরুচি নিয়ে সমাজপতিদের এত ‘হা রে রে রে’ ডাক।
দেওয়ালে পিঠ, আবার। আদালতের রায়ের প্রতিবাদে। কলকাতা, ১১-১২। ছবি: পি টি আই।
যৌন সংসর্গের ক্ষেত্রে প্রকৃতির অভিপ্রায় কী? এর কোনও নিশ্চিত উত্তর বলা সম্ভব নয়। প্রকৃতি এমনিতে নানা বৈচিত্রের পক্ষপাতী। আমরা সেই বৈচিত্রকে সসম্মান মেনে নিই, তাকে গৌরবান্বিত করি। অথচ যৌনতার ক্ষেত্রে হিসেবটা পাল্টে যায়। তার প্রধান কারণ, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র, অন্তত তার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ, বিষয়টি বিচার করেন ‘ফল’ দিয়ে, তার ভিত্তিতেই প্রকৃতির অভিপ্রায়কে নির্দিষ্ট করতে চান। ফলেই বৃক্ষের পরিচয় কথাটি এমনিতে সাদামাটা। কিন্তু এই প্রাকৃতিক উপমাটি যখন মানুষের ওপর চেপে বসে, তখন ক্ষেত্রবিশেষে তা খুবই নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে। তখনই প্রশ্ন ওঠে: মিলিত তো হলে, কিন্তু যৌনতার ফলটি কী? বাচ্চা কোথায়? মনু তাঁর সংহিতায় একাধিক শ্লোকে জানিয়ে দিয়েছিলেন সন্তানের জন্যই নারীর সমাদর, উৎপাদনের জন্যই সামাজিক নানাপ্রকার বিবাহ। বাচ্চা বলছি বটে, কিন্তু এখনও পুরুষতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজের বড় অংশের প্রশ্ন: ছেলে কোথায়? পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। পুত্র হলে সে পরকালে পুন্নাম নরক থেকে রক্ষা করবে, ইহলোকে বংশপরম্পরা বজায় রাখবে, পারিবারিক ধর্ম পালন করবে। তাই মহাভারতে রানিদের ছেলে না হলে নিয়োগ প্রথার বিধান, রূপকথার গল্পে রানি পুত্রবতী না হলেই নির্বাসন। যৌনতার আনন্দ, আনন্দের জন্যই আনন্দ এই বিচারে গৌণ। যৌনতার ফলটিই মুখ্য।
এই ভাবনা বহু দিন ধরে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ’ মানুষের সুবিধের জন্য গড়ে উঠেছে। এই দেশে পৃথিবী মা বসুন্ধরা হিসেবে সম্মানিত। এই রামায়ণের রাজ্যে সীতার আশ্রয়দাত্রী হিসেবে তিনি পূজিত। আর এই শস্যশালিনী আশ্রয়দাত্রী পৃথিবীর মতোই পতি-পত্নী-পুত্রবতী সুখী পরিবারের স্বপ্নে সবাই মশগুল। বহু মানুষের কাছে এর যে বিশেষ উপযোগিতা আছে, তা তো অস্বীকার করার উপায় নেই। সমাজ এবং রাষ্ট্রও তো মোটের ওপর তাই এই ছবিটিকেই সমর্থন করে। সন্তানাদি হলে তা সমাজের কাজে লাগে, দেশের কাজে লাগে দেশ ও সমাজ এই সব নাগরিকদের হাতে বিস্তার লাভ করে, বড় হয়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই তো বড় হতে চায় বংশলোপ তো মস্ত অভিশাপ!
কথাটা যে এ দেশেই বলা হয়েছিল তা নয়, অন্য দেশে ভদ্র ভাষায় একই ভাবে ঠারে-ঠোরে বলা হয়েছিল। সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর ১৯০৫-এ লেখা নিবন্ধ থ্রি এসেজ অন দ্য থিয়োরি অব সেক্সুয়ালিটি’তে ‘সেক্সুয়াল অবজেক্ট’ আর ‘সেক্সুয়াল এম’ এই দুইয়ের কথা লিখেছিলেন। নারীর কাছে পুরুষ আর পুরুষের কাছে নারী আমাদের মান্য সামাজিকতায় যৌন আকর্ষণের বিষয়, আর সন্তান উৎপাদন হল সেই যৌনতার একমাত্র লক্ষ্য। এর বাইরেও যৌনতা আছে। ফ্রয়েড সেই অন্যান্য যৌন প্রবণতা ও পছন্দকে ‘ডিভিয়েশনস ইন রেসপেক্ট অব দ্য সেক্সুয়াল অবজেক্ট’ উপশিরোনামে আলোচনা করেছিলেন। যৌন বিচ্যুতির প্রসঙ্গেই সেখানে আলোচিত হয়েছিল সমকামীদের কথা। কেন তাদের যৌন পছন্দ বিচ্যুত? কেন তা জনপ্রিয় নয়? ওই যে ফল নেই, সন্তান নেই।
এই যে ফল দিয়ে যৌনতার বিচার করা হচ্ছে, তা কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ‘অমানবিক’। মেয়েটির কোনও কারণে বাচ্চা হচ্ছে না, অমনি ভারতীয় সমাজে তার ওপর লাঞ্ছনা বর্ষিত হচ্ছে। ভারতীয় সমাজে অনেক সময়েই বউয়ের বাচ্চা হচ্ছে না, এই অপরাধে ছেলের আবার বিয়ে দেওয়া হত। এখন এতটা হয়তো হয় না, কিন্তু সন্তানহীন বাড়ির বউটি শুকনো মুখে বসে থাকে।
এই ছেলেমেয়ে ফলানো উপযোগবাদী যুক্তির বলিকাঠেই কিন্তু সমকামীদের ‘প্রকৃতিবিরুদ্ধ’ বলে খারিজ করা হচ্ছে। এই সংকীর্ণ যুক্তি ছেলেহারা বউকেই শুধু তাড়িয়ে দেয় না, যে যৌনতার লক্ষ্য সন্তান উৎপাদন নয় সেই সমকামকে পাপ, অজাচার ইত্যাদি বলে সামাজিক ভাবে বাতিল করে দেয়। অথচ যৌনতার তো একান্ত আনন্দের জগৎ আছে। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরস্পর মিলিত হয়ে আনন্দ পান, সেই আনন্দ উৎপাদনের আনন্দ নয়, ভালবেসে মিলিত হওয়ার আনন্দ। তার কী হবে!
এই আনন্দকে উপযোগবাদীরা খুবই ভয় পান। লাভের গাজর সামনে ঝুলিয়ে যে উপযোগবাদী সমাজ চলে, সমকামকে স্বীকার করলে সেই উপযোগবাদ অস্বীকার করতে হয়। তা হলে বড়ই বিপত্তি, চক্করটি ভেঙে পড়বে। কোন চক্র? পড়াশোনা করবে কেন? ভাল রেজাল্টের জন্য। ভাল রেজাল্ট করবে কেন? ভাল চাকরির জন্য। ভাল চাকরি করবে কেন? ভাল বিয়ের জন্য। ভাল বিয়ে করবে কেন? ভাল সন্তানের জন্য। ভাল সন্তানের কী ফল? ভাল পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র। সমকাম এই চক্রকে এক ভাবে প্রশ্ন করে বলে মূলধারা চমকে চমকে ওঠে। মাই ব্রাদার নিখিল ছবিটির কথা মনে পড়ে। নিয়মনিষ্ঠ বাবা ছেলেকে চ্যাম্পিয়ন সাঁতারু বানাতে চেয়েছিলেন। বাবার, পরিবারের নাম উজ্জ্বল করতে পারত যে ছেলে, সে হেতুহীন ফলহারা সমকামী প্রণয়ে লিপ্ত! বাবা ভাবতেই পারেন না। আপত্তি আপত্তি। রাগ রাগ।
কিন্তু সমকামীরা তো মূলধারা নিয়ে আপত্তি করেননি। তাঁরা তো বলেননি, মূলধারার মানুষকে সমকামী হতে হবে। মূলধারা যেমন চলছে চলুক না। তাঁরা শুধু নিজেদের ব্যক্তিগত যৌন পছন্দের স্বাধিকার চেয়েছেন। বিচ্যুত, পাপী ইত্যাদি চাপিয়ে দেওয়া তকমার বাইরে আত্মমর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। দুজন মানুষ সন্তান উৎপাদন করতে চান না, নিজেদের মতো ভালবাসতে চান। তাঁদের জীবন যাপনের আনন্দ, হেতুহীনতার আনন্দ। ছেলেমেয়ের প্রয়োজন বা বাধ্যবাধকতা এই সম্পর্কে নেই। তাকে সম্মান করব না কেন?
একটা কথা শেষে মনে হল। এর সঙ্গে হয়তো সমকামের কোনও সম্পর্ক নেই। হয়তো আছেও আবার। প্রাচীন ভারতের মন্দিরগাত্রে কেবল নানা রকম যৌনাচারের রূপায়ণই ছিল না মধ্যযুগের ভারত যে ভক্তিবাদী ধর্ম আন্দোলনের শরিক হয়েছিল সেই ভক্তিবাদ প্রেমধর্মকে মানত। সেই প্রেম হেতুহীন কিছুর জন্য নয়, কিছু চায় না। পরিবারতন্ত্র, প্রচলিত ধর্মতন্ত্র ও রাজতন্ত্র কিন্তু এদের ওপর বেজায় চটে গিয়েছিল।

লেখক বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.