গাড়িতে গাড়িতে লালবাতির উপদ্রব লইয়া সুপ্রিম কোর্ট সরব। যাঁহারা নিজেদের ভিআইপি অর্থাৎ অন্যদের অপেক্ষা বেশি সমান বলিয়া গণ্য করেন, তাঁহারাই গাড়িতে লালবাতি লাগাইয়া ঘোরাফেরা করিয়া থাকেন। কখনও সেই বাতি জ্বলিতে-নিভিতে থাকে, সেই সঙ্গে তারস্বরে বাজিতে থাকে ‘হুটার’ও। পথচারী, অন্যান্য যানবাহন এবং সমগ্র জনস্থানকে সচকিত, সন্ত্রস্ত করিয়া বিকট শব্দে ও চোখ-ধাঁধানো আলোয় ভিআইপি’রা অমর্ত্যলোকের বাসিন্দাদের ন্যায় বিপুল সুদূরের পানে চলিয়া যান। পদাতিক জনমণ্ডলী স্থাণুবৎ। তাঁহাদের জন্য রাস্তা সাফ করিয়া দেওয়া হয়, ট্রাফিক পুলিশ অন্য সব যানবাহন থামাইয়া দেয়, কোনও যান যাত্রাপথে ঢুকিয়া পড়িলে তাহার জন্য ধার্য থাকে শাস্তির খাঁড়া। রাজপুরুষ যাইতেছেন, অতএব দীনহীন প্রজারা সব তফাত যাউক। শীর্ষ আদালত এই প্রবণতা ও মনোভঙ্গিটিরই নিন্দা করিয়াছে।
এমন একটি বিষয়ে যে বারংবার আদালতকে, এমনকী দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে মাথা ঘামাইতে হইতেছে, ইহাই দেখাইয়া দেয়, স্বাধীনতার সাড়ে ছয় দশক পরেও ভারত এখনও যথার্থ প্রজাতন্ত্র হইয়া উঠিতে পারে নাই, রাজতন্ত্রের অবশেষগুলি ফাঁকফোকর দিয়া প্রায়শ উঁকি দিতেছে। শীর্ষ আদালত এই অনুশীলনের জন্য ঔপনিবেশিক যুগের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভ্যাসকে দায়ী ঠাহর করিয়াছে। রাজা ও রাজপুরুষদের জন্য প্রজাদের পথ ছাড়িয়া দেওয়ার রেওয়াজটি অবশ্য এশীয় রাজতন্ত্রের পুরানো, সময়-পরীক্ষিত ঐতিহ্য। এই দেশেই এমন ভিআইপি আছেন, যাঁহারা অন্যদের ব্যতিব্যস্ত করিয়া প্রশাসনকে সচকিত করিয়া নিজেদের ক্ষমতার গৌরব প্রকাশ করিতে দ্বিধাবোধ করেন। তাঁহাদের শিক্ষা, রুচিবোধ ও সভ্যতার সংস্কারে বাধে। কিন্তু সকলেই সমান নহেন। অনেকেই নিজেদের রাজপুরুষতুল্য বিশেষাধিকারের অধিকারী বলিয়া গণ্য করেন। তাঁহারা অবলীলায় লালবাতি লাগানো গাড়ি চড়িয়া ঘুরিয়া বেড়ান। পদাতিক জনসাধারণ হইতে নিজেদের কিছুটা ঊর্ধ্বে স্থাপন করার এই তাগিদ গণতান্ত্রিক তাগিদ নয়। ইহার মধ্যে ক্ষমতার দম্ভ যেমন আছে, নিজেকে বিশিষ্ট ভাবার তাড়না যেমন আছে, তেমনই আম জনতা হইতে নিজের সম্মানজনক দূরত্ব নির্ণয়ের তাগিদও বিলক্ষণ রহিয়াছে। প্রজাতান্ত্রিক চিন্তা-ভাবনার সহিত ইহা সমঞ্জস নয়।
ইহার জন্য অবশ্য প্রশাসন কম দায়ী নয়। কেন্দ্র বা রাজ্যের সরকার তথাকথিত ভিআইপিদের অন্যায় আবদার মানিতে গিয়া লালবাতির প্রাপকদের সংখ্যা বাড়াইয়া দিয়াছে। ইহা প্রথম অন্যায়। দ্বিতীয়ত, যাঁহারা লালবাতি পাইয়াছেন, তাঁহাদেরই বা সর্বদা লালবাতির প্রয়োজন হইবে কেন? তাঁহারা কোনও জরুরি বৈঠকে দ্রুত পৌঁছাইতে চাহিলে অন্য কথা। কিন্তু সর্বদা কেন লালবাতির সরকারি যান ধার্য হইবে? বস্তুত, সুপ্রিম কোর্ট যেমন বলিয়াছে, দমকলের গাড়ি কিংবা রোগী-বহনকারী অ্যাম্বুল্যান্স ব্যতীত অন্য কোনও যানবাহনই লালবাতি কিংবা হুটার ব্যবহারে অধিকারী নয়। আদালত অবশ্য সাংবিধানিক পদাধিকারীদের ছাড় দিয়াছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলিকে লালবাতি প্রাপকদের তালিকা হ্রস্ব করিতে বলিলে কি সেই ছাড় মঞ্জুর করা যায়, না কি তাহা করা উচিত? তবে নির্বাচিত সরকারের জনপ্রতিনিধিরা প্রাত্যহিক জীবনে জনসাধারণ হইতে দূরত্ব রচনার পন্থাগুলি পরিহার করেন, না আরও আঁকড়াইয়া ধরেন, তাহাই দেখিবার। |