ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অসাংবিধানিক নয় সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্তে অনেকেরই বিস্মিত প্রতিক্রিয়া: অনেক বিষয়েই আদালত আইনসভা বা প্রশাসন কী করিয়াছে বা করে নাই তাহার তোয়াক্কা না করিয়া রায় দিয়াছে, এ ক্ষেত্রে পৃথক ফল কেন? সত্যই বহু বিষয়ে সরকার বা জনপ্রতিনিধিরা কর্তব্যে অবহেলা করিলে সুপ্রিম কোর্ট তাহা পূরণ করিতে আগাইয়া আসে পরিবেশ দূষণ রোধে আদালতের ভূমিকা ইহার একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির। আবার, মৌলিক অধিকারের তালিকায় নূতন নূতন ধারণা সংযোগ করিয়া আদালত সরকারের কর্তব্যের পরিধি প্রসারিত করিয়া চলিয়াছে, তাহাও বহু-আলোচিত। সেই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সমকাম বিষয়ে বুধবারের রায়টিকে ব্যতিক্রমী বলিলে ভুল হইবে না। কিন্তু, ব্যতিক্রমী বলিয়াই এই রায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অভিনন্দনযোগ্য। আশা করা যায়, ইহা ব্যতিক্রমী হইয়াই থাকিবে না, সদর্থে ‘ঐতিহাসিক’ হইবে, অর্থাৎ নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করিবে।
সংযমের ইতিহাস। স্বাধিকারবোধের ইতিহাস। নিজস্ব ভূমিকায় সুস্থিত থাকিবার অভ্যাস। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিণামে এই দেশে নাগরিকদের যৌন আচরণের স্বাধীনতা খর্বিত হইবে, সেই পরিণাম একটি গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে লজ্জাকর হইবে, সভ্য পৃথিবীতে ভারতের উদার ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হইবে এই সকল আশঙ্কা সংগত, স্বাভাবিক, গুরুতর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে পরিণামের প্রশ্ন গৌণ, বস্তুত অপ্রাসঙ্গিক। আদালতের কাজ নীতি স্থির রাখিয়া সেই অনুসারে সিদ্ধান্ত স্থির করা। আদালত তাহাই করিয়াছে। সমকামিতা ভাল কি মন্দ, সমকামীর যৌনাচরণ নৈতিক কি অনৈতিক, সুপ্রিম কোর্ট তাহা বিচার করে নাই, কারণ তাহা সুপ্রিম কোর্টের বিচার্য নয়। তাহার কাজ ছিল দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংবিধানের পরিপন্থী কি না, বিচার করা। আদালত তাহা করিয়াছে। আর কিছু করে নাই। এই কারণেই তাহার সিদ্ধান্ত বরণীয়। ৩৭৭ ধারা লইয়া তাহার পরেও প্রশ্ন থাকিয়া যায়। এই আইন সংশোধন করিবার পক্ষে প্রবল যুক্তিও অনস্বীকার্য। কিন্তু তাহা আদালতের কাজ নয়। সেই কাজ আইনসভার। সুপ্রিম কোর্ট তাহার রায়ে সেই কর্তব্য পালনের প্রতি সুস্পষ্ট সংকেতও দিয়াছে।
স্বাধিকার-সংযমের চরম শর্ত মানিতে হইলে হয়তো এই সংকেতটুকুও না দেওয়াই বিধেয় ছিল আইন সংশোধনের প্রয়োজন আছে কি না, আদালত কেন সেই বিষয়ে আদৌ কোনও মন্তব্য করিবে, সে প্রশ্ন উঠিতেই পারে। তবে এই মন্তব্যের একটি বৃহত্তর প্রেক্ষিত থাকা সম্ভব। কয়েক দিন আগেই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের বৈধতা বিষয়ক একটি মামলায় রায় দিতে গিয়াও সর্বোচ্চ আদালত সংশ্লিষ্ট আইনটির সংশোধনের কথা তুলিয়াছে। এই অভিমতগুলি হইতে আইনসভা ও প্রশাসনের একটি মৌলিক শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরি। বৃহত্তর সমাজেরও। কর্তব্য পালনের শিক্ষা। যুগের প্রয়োজনে আইন সংশোধনের প্রয়োজন হইতেই পারে। সেই কাজ আইনসভার। আইনসভাকে সেই কাজে প্রবৃত্ত করিতে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এবং, তাহার পাশাপাশি সমাজের কাজ প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য রাজনীতিকদের উপর গণতান্ত্রিক চাপ সৃষ্টি করা। এই বিভিন্ন বর্গ বা প্রতিষ্ঠানগুলি কেহ আপন কর্তব্য সম্পাদন করিবে না, ৩৭৭ ধারা সংশোধনের প্রশ্নে বিভিন্ন দলের রাজনীতিকরা ধরি মাছ না ছুঁই পানি নীতি অনুসরণ করিয়া ভোট বাঁচাইতে যত্নবান থাকিবেন, প্রতিবাদীরা সেই তঞ্চকতার মুখোশ খুলিতে যথেষ্ট পরিশ্রম না করিয়া কেবল আদালতের রায়ের সমালোচনা করিবেন, সমস্ত সংস্কার আদালতের মাধ্যমে সারিয়া ফেলা হইবে ইহা চলিতে পারে না। সুপ্রিম কোর্টের রায় ও মন্তব্য পরোক্ষে সেই কথা জানাইয়া দিয়াছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতেও আদালত অতিসক্রিয়তার পরিবর্তে স্বাধিকার-সংযমের পথেই সুস্থিত থাকিবে। |