আর কোনও আগাম ঘোষণা নয়। ‘রাজাকার শিরোমণি’ কাদের মোল্লাকে চুপচাপ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিল বাংলাদেশ
সরকার। রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হতেই শাহবাগ চত্বরে জড়ো হওয়া হাজার হাজার মানুষ বিজয়োল্লাসে মেতে ওঠেন। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকা। স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল রাস্তা পরিক্রমা করে। আতশবাজিতে মুছে যায় অন্ধকার। রাজশাহি, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল-সহ দেশের সব প্রান্তেই ফাঁসির খবর পাওয়া মাত্র মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে আসেন। ফেটে পড়েন উল্লাসে। পাশাপাশি প্রতিশোধের হুমকি দিয়ে নাশকতায় মেতেছে জামাতে ইসলামি। রবিবার তারা হরতালও ডেকেছে।
|
কাদের মোল্লা |
জেল সূত্রের খবর, সন্ধ্যা সাতটাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ডেকে পাঠানো হয় ছয় জল্লাদকে। তাঁরা পাকা কলা চটকে ও গ্রিজ দিয়ে দড়িটিকে পিচ্ছিল করে টাঙিয়ে দেন ফাঁসিকাঠে। বালির ভারী বস্তা ঝুলিয়ে তা পরীক্ষাও করে নেওয়া হয়। রাত ন’টার কিছু পরে জেল গেটে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে ঢুকে যান জেলের সার্জন ও এক মৌলবি। এর পরে কাদের মোল্লাকে স্নান করিয়ে নমাজ পড়ানো হয়। মঙ্গলবার রাতেও এই পর্যন্ত কাজ এগিয়ে গিয়েছিল। তার পরে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ এসে পৌঁছনোয় ফাঁসি রদ হয়ে যায়।
এ বারে আর তার সুযোগ ছিল না। তাই প্রার্থনার পরে জেলের সার্জন কাদের মোল্লার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। একাত্তরে ঠান্ডা মাথায় যিনি কিশোর-বৃদ্ধ নির্বিশেষে অজস্র মুক্তিকামী মানুষকে নির্যাতন করে খুন করিয়েছেন, নিজের শেষ সময়ে সেই কাদের মোল্লা কিন্তু খুবই ভেঙে পড়েন। নিয়ম মাফিক একটি নির্জন কক্ষে প্রায় আধ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয় বছর পঁয়ষট্টির এই জামাত নেতাকে। তার পরে পোশাক পাল্টে বিশেষ আলখাল্লা পরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। ফাঁসিকাঠে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করানোর পরে এক জল্লাদ তাঁর মুখ ঢেকে দেন কালো কাপড়ের মুখোশে। আর এক জল্লাদ দড়ি পরিয়ে দেন গলায়। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র হাতল টেনে পায়ের নীচের পাটাতন খুলে দেন অন্য জল্লাদ। তার পরে সার্জন এসে দেহ পরীক্ষা করে জানান তিনি মৃত। এর পরে দড়ি থেকে খুলে নেওয়া হয় এই রাজাকার-প্রধানের দেহ। শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহ পাঠিয়ে দেওয়া হয় ফরিদপুরে, তাঁর মায়ের কবরের পাশে দাফন করার জন্য। |
ফাঁসির পর মশাল জ্বেলে উদযাপন শাহবাগ চত্বরে। ছবি: এপি। |
সন্ধ্যা ছ’টায় কাদেরের পরিবারকে ফের যখন জেলে ডেকে পাঠানো হয়, তখনই পরিষ্কার হয়ে যায় সরকার আর কালক্ষেপে রাজি নয়। দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দেয়। তার পরে ‘মিরপুরের কসাই’ জামাতে ইসলামির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার ফাঁসি শুধু সময়ের অপেক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। মঙ্গলবার রাতেই তাঁর ফাঁসি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বিকেলেই তা ঘোষণা করে দেওয়ায়, কাদের মোল্লার আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ পান। ফাঁসির ঘণ্টা দেড়েক আগে সুপ্রিম কোর্টের স্থগিতাদেশ জেলে এসে পৌঁছলে তা রদ হয়ে যায়।
এ দিকে, সাজানো বিচারে আওয়ামি লিগ সরকার তাদের নেতাকে খুন করেছে এই অভিযোগ করে ভয়াবহ প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছে জামাতে ইসলামি। দেশের নানা জায়গায় গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোমাও ফাটানো শুরু হয়। কুষ্ঠিয়ায় তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর পৈতৃক বাড়িতে পর পর তিনটি পেট্রোল বোমা ছোড়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের এক বিচারপতির বাড়িতেও হামলা করা হয়। রিভিউ পিটিশন খারিজ করা দুই বিচারপতির নামে ফেসবুকে ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ জারি করে বলা হয়, সুযোগ পাওয়া মাত্র এই পরোয়ানা কার্যকর করা হবে। ফেনী ও লক্ষ্মীপুরে জামাত-শিবির কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পাঁচ জন প্রাণ হারিয়েছেন। কাদের মোল্লার ফাঁসির পরে নাশকতা আরও বাড়বে আশঙ্কা করে গোটা দেশেই নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ দিন বিকেলেই আইনরক্ষক বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক। তার পর তিনি জানান, পুলিশ ছাড়া বিজিবি ও আনসারদের সব গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় মোতায়েন করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনার রকিবুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, নির্বাচনের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরির জন্য সেনাবাহিনীকে তৈরি রাখা হয়েছে। প্রয়োজন হলেই মোতায়েন করা হবে। তিনি জানান, জানুয়ারির ৫ তারিখে নির্বাচন করার লক্ষ্যেই তাঁরা এগিয়ে চলেছেন।
এ দিকে নয়াদিল্লির খবর, কাদের মোল্লার ফাঁসির আগেই এ দিন বিএসএফের বিরাট বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তে মোতায়েন হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে সীমান্ত এলাকায় বাড়তি নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র। শরণার্থীদের ওপর গুলি না চালানোর জন্য বিএসএফ-কে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
|