দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার অনড় মনোভাবের জেরে হঠাৎই আন্তর্জাতিক মহলের আগ্রহের কেন্দ্রে বাংলাদেশ। নির্বাচন নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় ঢাকায় এসে পাঁচ দিন ধরে দৌত্য চালিয়ে এ দিনই ফিরে গেলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব। তার পরে আজই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন খোদ মহাসচিব বান কি মুন। আবার বুধবারই টেলিফোনে হাসিনার সঙ্গে কথা বললেন আমেরিকার বিদেশসচিব জন কেরি। কিন্তু এত কিছুর পরও বাংলাদেশের মানুষের জন্য আশার খবর খুব একটা নেই। রাজনৈতিক সঙ্কট কাটার তেমন কোনও লক্ষণ নেই।
মঙ্গলবার গভীর রাতে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে একেবারে শেষ সময়ে স্থগিত হয়ে যায় একাত্তরে গণহত্যার নায়ক জামাতে ইসলামির নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি। আসামি রিভিউয়ের সুযোগ পেতে পারেন কি না, তার শুনানি হবে কাল। কাদের মোল্লার আইনজীবীরা রিভিউয়ের আর্জি জানালেও সরকারের সাফ কথা আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইনে তার কোনও সুযোগ নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এ দিনও সেই যুক্তিই দিয়েছেন। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে একটি বিশেষ বেঞ্চ কাল দু’পক্ষের সওয়াল শুনে সিদ্ধান্ত জানাবেন। অর্থাৎ কাদের মোল্লার ফাঁসিতে ঝোলার পর্ব আপাতত ঝুলেই রইল। আর এই ঘটনাই অক্সিজেন জুগিয়েছে জামাত-শিবিরের নৈরাজ্যে। দেশের নানা জায়গায় আজও ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে জামাত কর্মীরা। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ তাদের আক্রমণের নিশানা হয়েছে। বিচারপতি এস কে সিনহা কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ দিয়েছিলেন। আজ এক দল জামাত কর্মী হামলা চালিয়ে মৌলবিবাজারে তাঁর বাড়ি লুঠপাট করে জ্বালিয়ে দিয়েছে। গাড়ি ও মোটর সাইকেলে চড়ে এসে জামাতের কর্মীরা এই অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পালিয়ে যায়। পরে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি সামলায়।
কাল দেশে ফেরার কথা থাকলেও ঢাকায় থাকার মেয়াদ এক দিন বাড়িয়েছিলেন দৌত্যে আসা রাষ্ট্রপুঞ্জের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকো। তাঁর মধ্যস্থতায় কালই একান্ত বৈঠকে বসেছিলেন শাসক দল আওয়ামি লিগ ও বিরোধী বিএনপি-র মহাসচিবরা। আজও ফের বৈঠক হয়। ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন এবং মার্কিন বিদেশসচিব জন কেরি। তার পরে তারানকো সাংবাদিক সম্মেলনে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান নিয়ে নানা আশার কথা বললেও, সুনির্দিষ্ট কোনও সমাধানের পন্থা বাতলাতে পারেননি। দেশে ফেরার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথা থাকলেও তা বাতিল হয়ে যায়। তারানকোর দৌত্যে যে ফল হয়নি, এ ঘটনায় তা আরও স্পষ্ট হয়ে যায়।
এ দিকে শেষ সময়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি রদ হয়ে যাওয়ায় ফের ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে শাহবাগ চত্বরে। ফাঁসির রায় কার্যকর করার দাবিতে ফের অবস্থান আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ। এ দিন সকালে আচমকা শাহবাগ চত্বরে ঢুকে পড়ে বোমা ছোড়ে সন্দেহভাজন এক জামাত কর্মী। এ ঘটনায় কেউ হতাহত না হলেও অবস্থানকারীরা তাড়া করে আততায়ীকে ধরে ফেলে। তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। কাদের মোল্লার ফাঁসি রদ হয়ে যাওয়ার পিছনে সরকারের গোপন বোঝাপড়া রয়েছে বলে অভিযোগ করেন শাহবাগে জমায়েত বহু তরুণ। তাঁদের কথায়, কোথাও কখনও সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে ঘোষণা করে কাউকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বলে শোনা যায় না। বাংলাদেশে সম্প্রতি মুজিবর রহমানের হত্যাকারী থেকে বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গি নেতাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। কখনওই এ ভাবে আগে থেকে ঘোষণা করে তা করা হয়নি। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এমন ঘটনার নজির বিশেষ নেই। শাহবাগের তরুণদের অভিযোগ, কাদের মোল্লার আইনজীবীদের আপিল করার সুযোগ করে দিতেই রাতে ফাঁসি দেওয়ার কথা বিকেল বেলায় আগাম ঘোষণা করেছে সরকার। তবে সরকারের এক মন্ত্রীর যুক্তি ষড়যন্ত্র নয়, সরকারের একটা মহলের বোকামি ও আহাম্মকির জন্যই কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর গেল না। কয়েক জন মন্ত্রী ভেবেছিলেন, ফাঁসির কথা আগাম ঘোষণা করে নির্বাচনের আগে বাহবা কুড়োবেন। তাঁদের এই কাজের জন্যই অন্তত কিছু দিনের জন্য প্রাণ ফিরে পেলেন ‘মিরপুরের কসাই’।
|