আসামিকে স্নান করিয়ে নমাজ পড়ানো শেষ। জল্লাদরা পাকা কলা আর গ্রিজ মাখানো দড়ি প্রাণপণে টেনেটুনে দেখছেন। জরুরি তলব পেয়ে হাজির জেলের সার্জেনও। সময় বাকি ঘণ্টা দেড়েক। এমন সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এসে পৌঁছল সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির স্থগিতাদেশ। বুধবার সকাল পর্যন্ত কার্যকর করা যাবে না কাদের মোল্লার ফাঁসি। আবার অন্তত কিছু ক্ষণের জন্য প্রাণ ফিরে পেলেন একাত্তরে গণহত্যা, ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত রাজাকার শিরোমণি কাদের মোল্লা।
কাদের মোল্লা।
|
নাটকের পর নাটক। রাষ্ট্রপুঞ্জের দৌত্যে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কট কাটার রুপোলি ইঙ্গিত মিলল মঙ্গলবার, আর সে দিনই যুদ্ধাপরাধে দোষী সাব্যস্ত জামাত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করতে এগিয়ে যায় শেখ হাসিনার সরকার। রিভিউয়ের সুযোগ না দিয়ে সরকার তাদের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেলকে ফাঁসি দিচ্ছে এই যুক্তি তুলে জামাতের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সইদ মাহমুদ হোসেনের দ্বারস্থ হন। এর পরে রাতেই বিচারপতি ফাঁসি কার্যকর করার ওপর স্থগিতাদেশ দেন। গভীর রাতে সেই নির্দেশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌছে যাওয়ায় ফাঁসি আপাতত রদ হয়ে গেল।
এ দিন সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু জানান, রাতেই কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হবে। সঙ্গে সঙ্গে বিবৃতি দিয়ে ‘ভয়াবহ পরিণতি’র হুমকি দেয় জামাতে ইসলামি। সমস্ত জামাতিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাক দিয়ে মোবাইল ফোনে এসএমএস ছড়ানো শুরু হয়। ঢাকা জেলের বাইরে একের পর এক বোমা ফাটতে থাকে। ‘মিরপুরের কসাই’ নামে পরিচিত এই কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতেই ৫ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে শুরু হয়েছিল গণজাগরণ আন্দোলন। ফাঁসির অপেক্ষায় এ দিন সন্ধ্যা থেকেই ফের ভরে ওঠে শাহবাগ চত্বর। কিন্তু ফাঁসি স্থগিতের খবর আসা মাত্র হতাশ হয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা।
বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী জামাতে ইসলামির লাগাতার হরতাল ও অবরোধে গত এক মাস ধরে বাংলাদেশের জনজীবন বিপর্যস্ত। একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনায় অন্তত ৭০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আজও রাজশাহিতে এক পুলিশ অফিসারের বন্দুক কেড়ে নিয়ে তাঁর হাত-পা ভেঙে দিয়েছে জামাত কর্মীরা। জামাতের আর এক শীর্ষ নেতা দেলওয়ার হোসেন সাইদির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়া মুস্তাফা হাওলাদারকে আজই কুপিয়ে খুন করা হয়েছে। মুস্তাফার স্ত্রী আততায়ীদের জামাত-কর্মী বলে চিহ্নিত করেছেন।
নির্বাচনী সরকার নিয়ে শাসক আওয়ামি লিগ ও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি-র মধ্যে মতভেদ যে বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তা সহজ করতে রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকোকে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন। গত চার দিন তিনি রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন ও বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে সঙ্কট নিরসনের ফর্মুলা খোঁজেন। তাঁর মধ্যস্থতাতেই আজ একান্তে বৈঠকে বসেন আওয়ামি লিগ ও বিএনপি-র দুই মহাসচিব সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও মির্জা ফখরুল ইসলাম। দু’দলের প্রথম সারির নেতারাও ছিলেন বৈঠকে। সূত্রের খবর, এই বৈঠকেই বরফ গলার ইঙ্গিত মেলে। আজ রাতেই তারানকোর ফিরে যাওয়ার কথা থাকলেও বিকেলে তিনি জানান, আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। দু’পক্ষ আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যেতে সম্মত হয়েছেন। এ জন্য তিনি দেশে ফেরা স্থগিত রাখছেন। বিএনপি-ও জানায়, আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিয়েছে। দু’পক্ষই আলোচনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
সাত মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষ ‘আলোচনা’ ও ‘ঐকমত্য’ এই দু’টি শব্দ শুনতে মুখিয়ে থাকলেও আওয়ামি লিগ ও বিএনপি-র অনড় অবস্থানে তা সম্ভব হয়নি। নির্বাচন ঘোষণার পরেও খালেদা জিয়ার দল বিএনপি তা বয়কট করে লাগাতার হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যায়। এই পরিস্থিতিতে তারানকোর দৌত্যে রাজনৈতিক সঙ্কট কাটার একটা সম্ভাবনায় সবাই যখন স্বস্তি খুঁজছেন, ঠিক সেই সময়েই সরকারের একটা ফরমান পৌঁছে যায় ঢাকার জেলে বন্দি কাদের মোল্লার পরিবারের কাছে। বিকেলের মধ্যেই জেলে গিয়ে জামাত নেতার সঙ্গে দেখা করে আসতে বলা হয় তাঁদের। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় সরকার যে আজই কার্যকর করতে চলেছে, তা স্পষ্ট হয়ে যায়। আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম জানান, এই রাজাকার-প্রধান প্রাণভিক্ষা চাইতে অস্বীকার করার পরেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এর পরে কাদের মোল্লার আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সইদ মাহমুদ হোসেনের দ্বারস্থ হয়ে বলেন, রিভিউয়ের সুযোগ না দিয়ে সরকার ফাঁসির রায় কার্যকর করছেন। সর্বোচ্চ আদালত যেন এ কাজে স্থগিতাদেশ দেন। এর পরে ওই বিচারপতি বুধবার সকাল পর্যন্ত ফাঁসি কার্যকরের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। লোক না-থাকায় কাদের মোল্লার আইনজীবীরাই সেই নির্দেশ কারা কর্তৃপক্ষের কাছে দিয়ে আসেন। স্থগিত হয়ে যায় জামাত নেতার ফাঁসি। |