বৃষ্টির আবহেও উষ্ণ মিলন, দূরত্ব মুছলেন ম্যান্ডেলা
১০ ডিসেম্বর
বিশ্বাস্য স্মরণসভা!
যার প্রতি লহমায় তৈরি হল প্রায় অসম্ভব কিছু মুহূর্ত। কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ত্রো হাসলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দিকে তাকিয়ে। সহাস্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন ওবামাও। হল উষ্ণ করমর্দন। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে সাপে-নেউলে সম্পর্ক যে দু’দেশের, সে দু’দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কি না হাত মেলালেন? বিশ্বাস হয় না। অথচ তা-ই হল। সাক্ষী রইলেন দক্ষিণ আফ্রিকার দশ হাজারেরও বেশি মানুষ। সাক্ষী রইল জোহানেসবার্গের এফএনবি স্টেডিয়াম। অলক্ষে বোধ হয় গোটাটাই দেখলেন নেলসন ম্যান্ডেলা।
মঙ্গলবার তাঁরই স্মরণসভার আয়োজন করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। হাজির ছিলেন নানা দেশের একশোরও বেশি রাজনীতিক, নেতা ও রাষ্ট্রপ্রধান। ছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার বহু মানুষ। শোকস্তব্ধ নন কেউই। প্রত্যেকের মুখেই স্লোগান, জাতীয় সঙ্গীত, আর ‘ভুভুজেলা’। মৃত্যু নয়, এ দিনও ম্যান্ডেলার জীবনই উদ্যাপন করলেন তাঁরা। হেসে, নেচে, গেয়ে অতিবৃদ্ধ ‘টাটা’কে (পিতা) স্মরণ করলেন তাঁরা। তাঁদের নিরন্তর সঙ্গত করল রক ব্যান্ড। এ জন্য অবশ্য অনুষ্ঠানের মাঝে অল্প ক্ষণের ছন্দপতনও হয়। তখন ‘মাদিবা’কে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ও দিকে আপন মনে বাজিয়েই চলেছেন ব্যান্ড সদস্যরা। সঙ্গে দশ হাজার দর্শকের চিৎকার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে মাইক ধরতে হল ‘আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ (এএনসি) দলের ডেপুটি প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাপোজাকে। প্রথমে ইংরেজিতে এবং জুলু ভাষায় বললেন, “আমরা জানি আপনারা খুব ভাল বাজান। কিন্তু আপাতত বাজনাটা বন্ধ রাখুন।”
ম্যান্ডেলার স্মরণসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট
বারাক ওবামা। মঙ্গলবার জোহানেসবার্গে। ছবি: এএফপি।
কিছুটা যেন শান্ত হল জনতা। কিছু বাদেই ফের শুরু চিৎকার। যে জনতা মার্কিন প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাতে গিয়ে উত্তাল হয়ে উঠতে পারে আবার একই দিনে আপন দেশের প্রেসিডেন্টকেই শোনাতে পারে তাচ্ছিল্যের সুর, সে জনতা আর যাই হোক, অসৎ নয়। ক্ষণিকের নীরবতার ভান আর তাই বেশি ক্ষণ টিকল না। চিৎকারের ফাঁকেই প্রণববাবু বললেন, “ওঁর জীবন এবং সংগ্রাম দক্ষিণ আফ্রিকা তথা গোটা বিশ্বের পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর কাছে ‘আশা’র প্রতিমূর্তি। যা আমাদের জাতীয় পিতা মহাত্মা গাঁধীর নীতির কথা মনে করায়।” তিনি আরও বলেন, “অবিচার ও অসাম্যের বিরুদ্ধে নিজের মতো করে চালিয়ে যাওয়া ‘সত্যাগ্রহ’ কোনও দিন থামাননি ম্যান্ডেলা। তাঁর দৃঢ়তা, ধৈর্য ভারতে মহাত্মা গাঁধীর পদ্ধতির কথা মনে করায়।”
গাঁধীর সঙ্গে ম্যান্ডেলার মিল খুঁজে পেয়েছেন স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্টও। তাঁর মতে, গাঁধীর মতো ম্যান্ডেলাও এমন আন্দোলনের পথে হেঁটেছিলেন যার সাফল্যের সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। একই সঙ্গে ওবামার অম্লান স্বীকারোক্তি, “দক্ষিণ আফ্রিকার মতো আমেরিকাকেও জাতপাতের বৈষম্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।” তবে তিনি এবং মিশেল যে ম্যান্ডেলার মতোই বহু মানুষের সংগ্রামের সুফল পাচ্ছেন, সে কথাও এ দিন নির্দ্বিধায় মেনে নেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। মাদিবার স্মরণসভায় এ মুহূর্ত যেন আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধানের নিজের লড়াইয়েরই কাহিনি তুলে ধরল। ইতিহাস তো এটাও বলছে, মাদিবার মতো ওবামাও তাঁর দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট।
মঙ্গলবার গোটা অনুষ্ঠানটাই ছিল এ রকম বহু আজব মুহূর্তে ভরা। স্মরণসভার গোড়ায় ম্যান্ডেলার আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা করেছে এফএনবি স্টেডিয়াম। সে প্রার্থনাতেও জায়গা পেয়েছে বিশুদ্ধ সংস্কৃত শ্লোক। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একে অপরের চিরশত্রু হিসেবে পরিচিত দেশের প্রধানরাও এ দিন সৌজন্যই দেখিয়েছেন। ওবামা-কাস্ত্রো(রাউল) তো বটেই, অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এসেছেন জিম্বাবোয়ের প্রেসিডেন্ট রবার্ট মুগাবে এবং ব্রিটেনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ার। ইতিহাস বলছে, অতীতে পরস্পরকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছেন এই দুই নেতা। কিন্তু এ দিনের স্মরণসভায় তার আঁচ পড়েনি। ‘ম্যান্ডেলা-ম্যাজিক’ বোধ হয় একেই বলে। সে জাদুর জোরেই ১৬ ঘণ্টার বিমানসফরে পরস্পরের সঙ্গী হলেন ওবামা এবং তাঁর পূর্বসূরি জর্জ বুশ, দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পাশাপাশি এলেন সনিয়া গাঁধী ও সুষমা স্বরাজ, রাজনৈতিক মুখের ভিড়ে দিব্যি খাপ খাইয়ে নিলেন ওপরা উইনফ্রে কিংবা নাওমি ক্যাম্পবেলের মতো বিনোদন দুনিয়ার তারকারা। রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন বলে উঠলেন ম্যান্ডেলাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।
জাদুর খেল অবশ্য এতেই শেষ নয়। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, যে দিন মারা গেলেন মাদিবা, সে দিন থেকেই আকাশের মুখ ভার। আর মঙ্গলবার তো প্রায় গোটা দিনটাই কাটল বৃষ্টির আবহে। দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দাদের কাছে এটা শুভ লক্ষণ। তাঁদের বিশ্বাস, কোনও মহাপুরুষ যখন পূর্বসূরিদের কাছে ফিরে যান, তখনই প্রকৃতি এমন রূপ নেয়। সে বিশ্বাসে আস্থা বাড়াল আজকের সমাপতন। টুকরো টুকরো বিশ্বকে কয়েক ঘণ্টার জন্য এক ছাদের তলায় নিয়ে এলেন যিনি, তিনি ‘মহামানব’-ই বটে। আর ঘটনাচক্রে তাঁর স্মরণসভা যে দিনটিতে অনুষ্ঠিত হল, সে দিনই বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। অবিশ্বাস্য স্মরণসভা আর কাকে বলে।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.