উপহার-সঙ্কট
লিভিং রুমের হোয়াইট বোর্ড প্ল্যানারের দিকে তাকালে আঁতকে ওঠাই স্বাভাবিক।
ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাস দু’টো তো ব্লু-ব্ল্যাক মার্কারেই ঢেকে গেছে।
এক একটা দিন তো দু’-তিনটে করে আমন্ত্রণের খবর জাহির করছে সকাল-সকাল।
কোনও দিন বিয়ে, কোনও দিন বৌভাত, তো পরের দিন কলিগের বিবাহবার্ষিকী, তার মাঝেই আবার এক দিন ‘বেস্ট বাডি’র স্ট্যাগ পার্টি। বিয়ের মরসুম শেষ হল তো শুরু হল গৃহপ্রবেশের আমন্ত্রণ। মাঝে বিদেশ থেকে বন্ধুর কলকাতায় ফেরা, ক্রিসমাস বা নিউ ইয়ার্স ইভ পার্টি তো আছেই।
‘কারও পৌষ মাস, তো কারও সর্বনাশ’ প্রবচনটা বোধহয় ‘ইনভিটেশন সিজন’য়ের সমস্যা মাথায় রেখেই কেউ ভেবেছিলেন! নেমন্তন্ন তো আছে। কিন্তু তা রক্ষা করতে গেলে তো একটা উপহার নিয়ে যেতে হবে!
দামের কথা ছেড়ে দিন। অন্তত উপলক্ষ আর পাত্রের কথা মাথায় রেখে তো উপহারটা হওয়া চাই। পারিবারিক আত্মীয়ের বিয়েতে দেওয়া উপহার তো আর অফিস কলিগের বিবাহবার্ষিকীতে দেওয়া যায় না।
একবার মুম্বইতে এক ক্রিকেট ম্যাচের প্রধান অতিথি জামসেদজি টাটা। কেউ ভেবে পাচ্ছে না ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে তাঁকে কী উপহার দেওয়া যায়? সুনীল গাওস্কর বাড়ি থেকে নিয়ে এলেন একটা ইন্ডিয়া ক্যাপ। আর তাতে নিজে অটোগ্রাফ করে দিলেন জামসেদজিকে। টাটার সব থাকতে পারে, এটা অন্তত নেই।
কিছু কিছু উপহার থাকে যা বাঙালির সব অনুষ্ঠানেই দেওয়া চলে। এমনই এক ক্ল্যাসিক উদাহরণ হল বই। কিন্তু এখনও কি লোকে নিজে হাতে র্যাপ করে বই উপহার দেয়? আনন্দ পাবলিশার্সের সুবীর মিত্র মানতে চান না, নেট এবং ই-বুক আসার পরে উপহারের জন্য বইয়ের বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। “এটা একটা মিথ। উপহারের জন্য বইয়ের বিক্রি প্রতি বিয়ের মরসুমে যেমন থাকে তেমনই আছে। অনেকে তো উপহার দেওয়ার জন্য আমাদের গিফ্ট কুপনও কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। যাঁরা কুপন উপহার পান, তাঁরা খুশি মতো বই নিয়ে যান,” বললেন সুবীরবাবু।
কিন্তু যার বই পড়ার অভ্যেসই নেই, তাকে বই উপহার দেওয়া তো ‘উলুবনে মুক্তো ছড়ানো’র মতো। তাই উপহার দেওয়ার সময় যাকে দেওয়া হচ্ছে, তার পছন্দ মনে রাখা সব থেকে জরুরি মনে করেন ফ্যাশন ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পল। বললেন, “বই পড়ার অভ্যেস থাকলে বই দেওয়া যেতে পারে। না হলে কাজে লাগবে এমন গিফ্ট দেওয়াই ভাল। সেটা ল্যাম্প শেড, পটেড প্ল্যান্ট... ছেলেদের জন্য লেদার বেল্ট, ল্যাপটপ ব্যাগ। তবে মেয়েদের উপহার দেওয়া অনেক সহজ। খুব কাছের কারওকে নিজের কালেকশনের কিছু একটা দিয়ে দিই। তবে সেটা উপলক্ষ দেখে।”
শুধু উপহার হিসেবে উপহার দেওয়ার চল যে বন্ধ হয়ে গেছে, সেটা কলকাতার প্রায় সব গিফ্ট শপের কর্মকর্তারা একবাক্যে স্বীকার করছেন। উপহার হিসেবে লোকজন এখন বেছে নিচ্ছেন এমন জিনিস, যা কাজে লাগবে। ছোট ফ্ল্যাটে এমনিতেই বেশি শো পিস রাখা যায় না। তাই সিলভার বা গোল্ড প্লেটেড রান্নাঘরের জিনিস সব থেকে বেশি চলছে। দাম একটু বেশি হলেও অন্যদের থেকে আলাদা হওয়ার জন্য অনেকেই এই রকম উপহার দিতে চাইছেন। অফিস কলিগ বা বস-য়ের বিবাহবার্ষিকীতে দামি ওয়াইনের বোতল তো অনেকেই দিতে পারেন। কিন্তু গোল্ড রিমড ওয়াইন গ্লাস বা সিলভার বটমড টাম্বলার বা শট গ্লাসের দাবার সেট দিলে ব্যাপারটা আরও ক্লাসি আর ‘আউট অব দ্য বক্স’ হবে নিঃসন্দেহে।
তবু উপহার কিনতে যাওয়া মানেই খানিকটা গালে হাত। বাজার দরের এখন যা অবস্থা, তাতে উৎসবপ্রিয় বাঙালি, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত বাঙালির প্রাণ খুলে উপহার দিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই কোপ উপহারের বাজেটে। পার্ক স্ট্রিটের বহু পুরনো গিফ্ট শপ গিগলসের ম্যানেজার তপন শ’, তাঁর আঠেরো বছরের অভিজ্ঞতায়ও খুব একটা আশার আলো দেখাতে পাচ্ছেন না। বললেন, “আমাদের বেশির ভাগ গিফ্ট-ই বিদেশ থেকে আসে। কিন্তু কয়েক বছরে ডলারের দাম যা বেড়েছে, গিফ্ট আইটেমের ইম্পোর্টাররাও বেশি করে জিনিস আনতে ভরসা পাচ্ছে না। ক্রেতাদের অবস্থাও একই রকম। তবে বিক্রি যে হচ্ছে না, তা নয়। বিক্রি ঠিকই হচ্ছে, হয়তো একটু সময় লাগছে। এই তো যেমন পোকার খেলার সেট আনিয়েছিলাম দেওয়ালির জন্য। এত দিন ওটা পড়েই ছিল। গতকাল একজন নিয়ে গেল হাউজ ওয়ার্মিং পার্টিতে গিফ্ট দেবে বলে।”
কিন্তু আমন্ত্রিত পারিবারিক আত্মীয় হলে প্রথাগত উপহার দেওয়াই স্বাভাবিক। হাউজিং বা পাড়াপড়শির ক্ষেত্রে একটু দামি বুটিকের শাড়িই এখন বেশ চলছে বিয়ের বাজারে। গায়ক রাঘব চট্টোপাধ্যায় বললেন, “এখন নেমন্তন্নের যা চাপ, কাকে কী দেব? তা নিয়ে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। নিকটাত্মীয় হলে চেষ্টা করি ট্র্যাডিশনাল কিছু দেওয়ার। গয়না বা শাড়িই তখন আমার একমাত্র পছন্দ। আত্মীয় নয়, তবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারওকে কোনও গিফ্ট দিতে হলে আমি পেন্টিং দিতে পছন্দ করি।”
তবে গয়না মানেই যে শুধু সোনা-রুপো দিতে হবে তা কিন্তু একেবারেই নয়। অনেকেই এখন অন্য গয়নার দিকে ঝুঁকছেন। কলকাতার এক বিখ্যাত গয়নার দোকান থেকে জানা গেল, উপহার হিসেবে ‘সুতোয় বাঁধা আদিবাসী গয়না’ এখন দারুণ জনপ্রিয়। রঙিন সুতোয় বাঁধা হালকা লকেট। দাম সাড়ে তিন থেকে চার হাজারের মধ্যে পড়বে। অল্পবয়েসিদের মধ্যে এমন উপহার এখন বেশ চলছে।
সম্পর্ক যদি বন্ধুস্থানীয় হয়, তা হলে ‘কাজের জিনিস’ দিতেই পারেন। কাজের জিনিস বলতে যেটা তারা ব্যবহারও করতে পারবে, আবার বাড়ি শিফ্ট করার সময় সঙ্গেও নিয়ে যেতে পারবে। এমন ধরনের উপহারের তালিকায় থাকে এক্সটারনাল হার্ডড্রাইভ থেকে ওয়্যারলেস মোডেম।
তবে গিফ্ট যা-ই হোক না কেন, তাতে নিজস্বতা না থাকলে আর কী হল? র্যালফ ওয়াল্ডো এমার্সন লিখেছিলেন না, ‘দ্য ওনলি গিফ্ট ইজ আ পোর্শন অব দাইসেল্ফ’। তার জন্যই তো পার্সোনালাইজড গিফ্ট। ক্রিস্টাল বলের মধ্যে নবদম্পতির ছবি কিংবা উপহার দেওয়া ইম্পোর্টেড হাতঘড়িতে ‘বিশেষ তার’ নাম লেখা বা হতে পারে বিদেশ ফেরত বন্ধুর জন্য কলেজের সময়ের ছবি আঁকা টি-শার্ট। এতটাই জনপ্রিয় এই পার্সোনালাইজড গিফ্ট, যে রবিবার সিটি সেন্টারে ‘প্রেস্টো’র সামনে লম্বা লাইন।
মনে আছে তো রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে কী উপহার দিয়েছিলেন বারাক ওবামা? রানির আমেরিকা ভ্রমণের ভিডিও ফুটেজ ভরা আইপড।
আজ রাতে নেমন্তন্নে যাওয়ার সময় কথাটা মনে রাখতে পারেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.