দুই ছেলেকে ফিরে পেলে তবেই বুঝবেন, জিতেছেন। জেলে ১৩ বছর কাটানোর পরে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে মুক্তি পেয়ে বলেছিলেন মুনমুন বসু।
তার পরে এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। কিন্তু সন্তানদের ফিরে পাওয়া তো দূরের কথা, এত বছর পরে দেখা করতে চেয়ে ছোট ছেলের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হলেন ওই মহিলা। স্বামী কুণাল বসুর হত্যাকাণ্ডের মামলায় বেকসুর খালাস পেয়েও ছেলেদের থেকে দূরত্ব ঘোচেনি তাঁর।
এই অবস্থায় আপাতত কলকাতা ছেড়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা রোডে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালিত মেয়েদের স্কুলে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মুনমুন। তিনি বলেন, “এমন ভাবে মগজধোলাই হয়েছে যে, মায়ের কাছেও ফিরতে চাইছে না ছেলে। কথা বলতে চাইছে না। উল্টে মাকে হুমকি দিচ্ছে, অপমান করছে।” তবে তাঁর প্রত্যয়, “হয়তো দেরি হবে, আমাকে আরও কষ্ট সহ্য করতে হবে। তবে ছেলেদের ফেরত পাবই। রক্তের সম্পর্ক এত সহজে মুছে যাবে নাকি!”
বুধবার ছিল মুনমুনের ছোট ছেলে সৌরনীলের জন্মদিন। সেই জন্য মঙ্গলবার রাতে সৌরনীলের মোবাইলে ফোন করেন তার মা। সৌরনীলের ডাকনাম সূর্য। স্বামীকে হত্যার অভিযোগে মুনমুনকে পুলিশ যখন গ্রেফতার করেছিল, সূর্য তখন সাড়ে তিন বছরের শিশু। তার পরে মা আর ছেলের এই প্রথম কথোপকথন। মুনমুন জানান, ফোনের ও-পারে তার মা রয়েছে বুঝতে পেরেই সূর্য তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘মা, তুমি আমাকে ফোন করেছ কেন? আমার নম্বরই বা কোথা থেকে পেলে?’ সূর্যকে মুনমুন জানান, তিনি তার মা। মা তো ছেলেকে ফোন করতেই পারেন। আর ফোন নম্বর জোগাড় করাটাও অসম্ভব ব্যাপার নয়। বুধবার সূর্যের জন্মদিনে তিনি যে তার সঙ্গে দেখা করতে চান, তা-ও জানান মুনমুন। কিন্তু তাঁর আশা পূরণ হয়নি। তিনি এ দিন বলেন, “সূর্য জানায়, সে আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় না। তার পরেই ও আমাকে হুমকি দিল, ‘তুমি তো জানো, আমরা তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি’।”
কী ব্যবস্থার কথা বলছে সূর্য?
মুনমুনের ধারণা, তিনি মুক্তি পাওয়ার পর থেকে তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন হুমকি পাচ্ছেন বলে পুলিশের কাছে যে-অভিযোগ করা হয়েছে, সূর্য সম্ভবত সে-কথাই বলতে চেয়েছে। মা অবশ্য ছেলেকে জানিয়ে দেন, তিনি কিছুই জানতে চান না। তিনি শুধু তার সঙ্গে দেখা করতে চান।
মুনমুন বুধবার সৌরনীলের স্কুলে গিয়ে দেখেন, সে এ দিন স্কুলেই যায়নি। দক্ষিণ কলকাতার একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ে সৌরনীল। ওই স্কুলে যাওয়ার আগে সকালে ছেলের মঙ্গলকামনায় কালীঘাটে পুজো দেন মা। ছেলের সঙ্গে দেখা না-হলেও স্কুলের অধ্যক্ষা, সহ-অধ্যক্ষা তাঁর সঙ্গে দেখা করে সৌরনীলের পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করেন। ছেলের জন্মদিনে মুনমুন নিয়ে গিয়েছিলেন কেক, চারশো লজেন্স, একটি পেন আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা-কার্ড। স্কুল-কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, কোনও পড়ুয়ার জন্মদিনে তাঁরা এই ধরনের উপহার গ্রহণ করেন না। তাই বিকেলে মিশনারিজ অব চ্যারিটিতে গিয়ে সেগুলো বিলিয়ে দেন মুনমুন।
ছোট ছেলের সঙ্গে কথা হলেও বড় ছেলে অভ্রনীলের সঙ্গে এখনও কথা হয়নি মুনমুনের। দুই ছেলেই তাদের ঠাকুরদার সঙ্গে থাকে। কিন্তু কারামুক্তির পরে অভ্রনীলকে ফোনেও পাননি মুনমুন। তিনি বলেন, “আর কী ভাবে যোগাযোগ করব, জানি না। তবে আমাকে তো খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে। সেই জন্যই চন্দ্রকোণা রোডে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার স্কুলে চাকরিটা নিচ্ছি।” পুরুলিয়া জেলে থাকার সময় মুনমুন কয়েদিদের পড়াতেন। বন্দিদের নিয়ে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক কাজকর্ম চালাতেন। সেই সময়েই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দুই মহিলা সেখানে যান। মুনমুনের পড়ানো এবং সংস্কৃতিকর্ম তাঁদের ভাল লাগে। সেই সূত্রেই মুক্তির পরে স্কুলে চাকরির প্রস্তাব আসে তাঁর কাছে। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিদের আজ, বৃহস্পতিবার মুনমুনের কাছে আসার কথা।
|