সহানুভূতি কাকে বলে? অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে, চোখে আঙুল দেখিয়ে কিছু পার্থক্য খাড়া করে, তার পরে গঙ্গাজল ছেটানোর মতো করে খানিকটা করুণা ছিটিয়ে দেওয়া? ক্যানসার-জয়ী মহিলাদের একটা বড় অংশেরই অভিজ্ঞতা অন্তত তেমনই। পরিবারে, দাম্পত্য জীবনে, অফিসে-ক্যানসার শব্দটাই তাঁদের আলাদা একটা পংক্তিতে রেখে দিচ্ছে। তাই আধুনিক নানা চিকিৎসার জোরে যতই তাঁরা মারণ রোগকে জয় করুন না কেন, মূলস্রোতে ফেরার পথটা অধরাই থেকে যাচ্ছে অধিকাংশের কাছে।
চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা, ক্যানসার সারলেও আগের জীবনে আর ফেরা হচ্ছে না বহু মহিলারই। দূরত্ব তৈরি হচ্ছে দাম্পত্যে। পরিবারে কোণঠাসা হতে হচ্ছে। আর কাজের জায়গাতেও বস্ বা সহকর্মীদের অতিরিক্ত মনোযোগ তাঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছে, তিনি আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা। ক্যানসার চিকিৎসকদের একটি সংগঠনের তরফে এই বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি এক আলোচনাচক্রেরও আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানেও চিকিৎসকেরা অনেকেই জানালেন, ঘটি-বাটি বিক্রি করে নতুন জীবন পাওয়ার আশায় চিকিৎসা চালান অনেকে। মারণ ব্যাধি কখনও কখনও হারও মানে। কিন্তু তার পরে?
পাঁচ বছর আগে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পরে একটা স্তন বাদ গিয়েছিল শ্রীময়ী চৌধুরীর। চিকিৎসকেরা বলছেন, এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। কিন্তু পরিবারে তাঁর কী অবস্থান? বালিগঞ্জের একটি উচ্চ মধবিত্ত পরিবারের গৃহবধূ, ৪৫ বছরের শ্রীময়ী বললেন, “বাইরে থেকে সব কিছু স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরে একটা চোরা স্রোত টের পাই।” তাঁর কথায়, “কিছু দিন আগে এক ননদের বিয়ে ছিল। সবাই বরণডালা সাজাতে ব্যস্ত। যেই আমি গেলাম, অমনি আমার শাশুড়ি বললেন, ‘তোমার শরীর ভাল নেই। তোমাকে ও সব করতে হবে না।’ বাকিরাও একই কথা বলল। বুঝলাম, ক্যানসার যতই সারুক, ওঁদের চোখে এখনও আমি সুস্থ-স্বাভাবিক নই।”
ক্যানসার সারিয়ে অফিসে ফের কাজে যোগ দেওয়ার পরে প্রথমে দায়িত্ব কমিয়ে দেওয়া হয় প্রথমা চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁর মুখের ভিতরে ক্যানসার হয়েছিল। বহুজাতিকে কর্মরতা ৪০ ছুঁই-ছুঁই প্রথমার কথায়, “মুম্বইয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছিলাম। ফেরার পরে অফিসে যোগ দিলাম। ভেবেছিলাম পুরনো জীবনে ফিরে যাব। কিন্তু বাস্তবে হল উল্টোটা।” কী রকম? প্রথমা বলেন, “বস্ বলছিলেন, আমাকে গুরুত্বপূর্ণ প্রোজেক্টে নেওয়া যাবে না। যদি ফের অসুস্থ হয়ে পড়ি! কার্যত বসে বসে মাইনে পাচ্ছিলাম। তার পরে মনে হল, এ ভাবে চলতে পারে না। প্রতিবাদ করলাম। মেল পাঠালাম সংস্থার সদর দফতরেও। এখন আমি ফের আগের পদে। কিন্তু বুঝতে পারি, সহকর্মীরা আমাকে তাঁদের সমকক্ষ ভাবতে পারছেন না।”
জরায়ুর ক্যানসার সারানোর পরে তাঁকে কী পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, তা জানালেন অন্য এক ক্যানসার-জয়ী। ৪৭ বছরের ওই মহিলাকে আপাতত সুস্থ বলে জানান চিকিৎসকেরা। তিনি জানালেন, রোগ ধরা পড়ার পর থেকে চিকিৎসা শেষ হয়ে আপাত স্বাভাবিক জীবন কাটাতে শুরু করার পরেও স্বামীর সঙ্গে তাঁর কোনও শারীরিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি। কেন? তাঁর জবাব, “উনি ভয় পাচ্ছেন। এক বার নিজেই বলেছিলেন, শারীরিক ঘনিষ্ঠতা হলে রোগটা ওঁর শরীরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দুরারোগ্য অন্য অসুখের সঙ্গে ক্যানসারকে একেবারেই এক পংক্তিতে ফেলা হয় না। ক্যানসার হওয়ার মানেই সেই ব্যক্তিকে ‘করুণার পাত্র’ বলে ধরে নেওয়া হয়। মহিলাদের ক্ষেত্রে তা আরও বেশি। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “ছোট ছোট বিষয় নিয়েও চর্চা হয়। ক্যানসারের পরে শারীরিক কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন, কেমোথেরাপির পরে চুল উঠে যায়। এক জন পুরুষের চুল উঠে গেলে সেই নিয়ে তোলপাড় হয় না। কিন্তু এক জন মহিলার চুল উঠে গেলে এমন গেল-গেল রব ওঠে, যেন চুল ছাড়া ওই মহিলার কিছু ছিলই না।”
ক্যানসার রোগীর প্রতি পরিবার ও সমাজের নিস্পৃহতা যে বহু সময়েই নিষ্ঠুরতার চেহারা নেয়, তা মেনে নিয়েছেন কম-বেশি সকলেই। বিশেষত ক্যানসার-আক্রান্ত মহিলাদের যৌন জীবনের বিষয়টিও ভাববার। ডাক্তাররা বার বার বলছেন, অস্ত্রোপচারে কোনও অঙ্গ বাদ গেলেও স্বাভাবিক যৌন জীবনযাপনে কোনও বাধা হয় না। কিন্তু অনেকেই যে সেটা মানতে চান না সে নজির মিলছে আকছার।
কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠের মতো পরিবারের তরফেও তো কিছু বক্তব্য থাকে। লড়াই তাঁদের তরফেও কি কিছু কম? ক্যানসার শল্য চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় শোনালেন তাঁর অভিজ্ঞতা। ছেলেটি ২৮। মেয়েটি ২৪। বিয়ের ঠিক পর পরই মেয়েটির স্তন ক্যানসার ধরা পড়ল। একটি স্তন বাদ গেল। ছেলেটি স্ত্রীকে সুস্থ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু ক্রমশ সেই প্রাণবন্ত যুবক কেমন যেন নিজের মধ্যেই গুটিয়ে যেতে শুরু করলেন। গৌতমবাবুর কথায়, “ওর মানসিক জোর বাড়াতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, তুমি ভেঙে পড়লে তোমার স্ত্রীকে কে সাহস দেবে? এক দিন ছেলেটি পাল্টা আমাকে বলল, আমিও তো রক্ত-মাংসের মানুষ। আমার জায়গায় আপনি থাকলে আপনিও কি এতটাই সহজ ভাবে সব কিছু দেখতেন?”
“আমি কোনও উত্তর দিতে পারিনি,” বললেন গৌতমবাবু। |