ঝাঁ চকচকে শহর। সব কিছু একেবারে নিয়ম মাফিক। এ হেন শহরের বুকে দাঙ্গা! রবিবার রাতে বাসের ধাক্কায় এক ভারতীয় শ্রমিকের মৃত্যুর জেরে এমনই ঘটনার সাক্ষী থাকলেন আতঙ্কিত সিঙ্গাপুরবাসী। গত ৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথম বার। সপ্তাহের শেষে রবিবার ছুটির দিনে রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ কেনাকাটা করতে বেরিয়েছিলেন লিটল ইন্ডিয়ার বাসিন্দারা। সিঙ্গাপুরের এই অঞ্চলে মূলত দক্ষিণ এশিয়া থেকে ঠিকা শ্রমিকের কাজ করতে আসা কর্মচারীদের আস্তানা। রাস্তা দিয়ে জোরে আসছিল একটা বেসরকারি বাস। হঠাৎই তার সামনে চলে আসেন শক্তিভেল কুমারভেলু। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় শক্তিভেলের। তামিলনাড়ুর বাসিন্দা ৩৩ বছর বয়সী কুমারভেলু নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে সিঙ্গাপুরে এসেছিলেন। সিঙ্গাপুর তাদের যাবতীয় নির্মাণ কাজের জন্য এই অভিবাসীদের উপরেই মূলত নির্ভরশীল।
চোখের সামনে এই ঘটনা দেখে উত্তেজিত হয়ে পড়েন স্থানীয় বাসিন্দারা। গুজব রটে যায়, চাকার তলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে কুমারভেলির দেহ। রাস্তায় নেমে পড়ে ৪০০ জনের একটা দল। শুরু হয়ে যায় রাস্তা অবরোধ, লুঠপাট-ভাঙচুর। স্থানীয় টিভি চ্যানেলে একটি ভিডিও ফুটেজ দেখানো হচ্ছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাসের চাকার তলায় তখনও আটকে রয়েছে মৃত ভারতীয় শ্রমিকের দেহ। আর এক দল যুবক বাসের কাচ ভাঙছে। বাসটিতে আগুন লাগানোরও চেষ্টা চলছে। খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। উত্তেজিত জনতা পুলিশেরও গাড়ি ভাঙচুর করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন লাগানো হয় অ্যাম্বুল্যান্সেও। |
ঘণ্টাখানেক পরে পুলিশের সংঘর্ষ দমন বাহিনীর বিশেষ দল ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলে ধরপাকড় শুরু করে। ঘণ্টাখানেকের চেষ্টায় শেষে অবস্থা আয়ত্তে আসে। এই ঘটনায় পুলিশের তিনটে গাড়ি, একটা মোটরবাইক, একটা অ্যাম্বুল্যান্স-সহ ১৬টা গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংঘর্ষের জেরে অন্তত ১৮ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে ১০ জনই পুলিশকর্মী। আহতদের মধ্যে ঘাতক বাসের চালকও রয়েছেন।
রবিবারের ঘটনার সাক্ষী বশির মেরিকান। ঘটনার সময়ে তিনি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তাঁর কথায়, “ওদের বেশির ভাগের হাতে বিয়ারের বোতল ছিল। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সবাই মাতাল। এক দল পুলিশকে লক্ষ্য করে বোতল ছুড়ছিল। আর বাকিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিল।”
সংঘর্ষ বাধানোর চেষ্টায় সিঙ্গাপুর পুলিশ ২৭ জনকে গ্রেফতার করেছে। এদের মধ্যে ২৪ জনই ভারতীয় শ্রমিক। বাকি তিন জনের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশি। কোনও সিঙ্গাপুরবাসী এই ঘটনায় জড়িত নয় বলে জানিয়েছেন শহরের পুলিশ কমিশনার এনজি জু হি। ধৃতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র সহযোগে দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের নিয়ম অনুযায়ী, এই অভিযোগে ধৃতদের ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে।
সংঘর্ষের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরেই বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য লেখা হতে থাকে। শেষে সোমবার দেশের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং এক ফেসবুক বার্তায় সবাইকে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “সিঙ্গাপুরের মতো দেশে এ রকম ঘটনা খূবই দুঃখজনক। অপরাধীদের ধরতে চেষ্টার কসুর করা হবে না। তবে গুজবে কান দেবেন না” ভিডিও ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। উপ প্রধানমন্ত্রী তিও চি হিন বলেন, “কোনও অপরাধীই পার পাবে না। সবাইকে আইন মেনেই শাস্তি ভোগ করতে হবে।” সিঙ্গাপুরে ভারতের হাইকমিশনার বিজয় ঠাকুর বলেন, “সিঙ্গাপুর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। কুমারভেলুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চলছে।” |