একের পর এক ভোটে বিপর্যয়ের পরে পথ খুঁজতে এ বার নিচুতলার নেতা-কর্মীদের মত জানতে চাইছে বর্ধমান জেলা সিপিএম।
সম্প্রতি জেলার প্রতিটি লোকাল কমিটিকে জেলা সম্পাদকের তরফে একগুচ্ছ প্রশ্ন সংবলিত চিঠি পাঠানো হয়। একেবারে শেষে জানতে চাওয়া হয়েছে ‘পরিকল্পনা ও পরামর্শ’। লোকাল কমিটিগুলির পাঠানো জবাব নিয়ে আজ, মঙ্গলবার জেলার ২৬টি জোনাল কমিটি বৈঠকে বসছে।
সিপিএমের জেলা কমিটির প্রবীণ এক নেতার দাবি, “এই রকম প্রশ্নপত্র পাঠিয়ে উত্তর চাওয়া কস্মিনকালেও হয়নি। এর মাধ্যমে আনুমানিক ২১ হাজার পার্টি সদস্যের বর্তমান অবস্থা জানা যাবে। বিরোধী ভূমিকায় থেকে কী রকম আন্দোলন করা দরকার, তা-ও বোঝা যাবে।”
এত দিন যে জেলা নেতারা কার্যত এক তরফা ভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়ে এসেছেন বলে দলেরই একটা বড় অংশের অভিযোগ, তাঁরা হঠাৎ নিচুতলার পরামর্শ চাওয়ায় অনেকেই বিস্মিত। নাম না ছাপার শর্তে গ্রামীণ বর্ধমানের একাধিক লোকাল কমিটির সম্পাদকের মতে, “এখন বহু সাধারণ নেতা-কর্মী দল ছাড়ছেন, সে কারণেই উপরতলার নেতাদের টনক নড়েছে। আমাদের গুরুত্ব দিতে চাইছেন।”
যদিও সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদারের দাবি, “কমিউনিস্ট পার্টি একটা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে চলে। তাই এটা নতুন কোনও বিষয় নয়।” দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, বর্ধমানের নেতা মদন ঘোষের বক্তব্য, “জেলা থেকে লোকাল কমিটিগুলোকে কী চিঠি দেওয়া হয়েছে, বিস্তারিত জানি না। তবে আমাদের দলে প্রয়োজনে এ রকম হয়েই থাকে।”
প্রশ্ন হল, এই সময়েই এমন চিঠি দিতে হল কেন?
সিপিএম সূত্রের খবর, বিধানসভা নির্বাচনের বিপর্যয় গত দু’বছরে আরও গভীর হয়েছে। এ বার লোকসভা ভোটের আগে লোকাল কমিটিগুলিকে পাঠানো এই চিঠি সম্ভবত পরিস্থিতি যাচাই করার একটা মরিয়া চেষ্টা। দলের নিচুতলার কর্মীদের মনোবল ঠিক কী অবস্থায়, তাঁরা কতটা ‘লড়াই’ দিতে প্রস্তুত, তা-ও ঠাহর করতে চাইছেন জেলা নেতৃত্ব। অনেকের মতেই, ১২৭টি লোকাল কমিটির বহু সদস্য কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়াতেই দলের ভরাডুবি হচ্ছে। তাই জানতে চাওয়া হয়েছে, লোকাল সদস্যদের মধ্যে কত জন নিষ্ক্রিয়, কত জন আধা-সক্রিয় এবং কত জন সক্রিয়? শাখা কমিটি, পার্টি সদস্য (পিএম) এবং নির্বাচিত সদস্যদের (সিএম) বর্তমান অবস্থা, দলে নতুন মুখের সংখ্যা কত বা তাঁদের মধ্যে কাউকে প্রাথমিক সদস্য পদ দেওয়া হয়েছে কি না।
চিঠির শেষে প্রচার নিয়ে লোকাল কমিটির ‘পরামর্শ’ ও দলকে কী ভাবে আন্দোলনমুখী করা যায়, সে ব্যাপারে ‘পরিকল্পনা’ চেয়েছেন উপরতলার নেতারা। ‘তৃণমূলের সন্ত্রাস’ কী ভাবে মোকাবিলা সম্ভব, তা-ও বোঝার চেষ্টা চলছে। গত লোকসভা ভোটের সময় থেকেই রায়না, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোটে থেকে বেশ কিছু পার্টি অফিস বন্ধ। সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে বর্ধমান পুর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে দলেই প্রশ্নের মুখে পড়ে গিয়েছিলেন জেলা নেতৃত্ব। এখন খোদ বর্ধমান শহরেও সব অফিস খুলতে পারছেন না তাঁরা।
তবে জেলা নেতাদের একাংশের দাবি, এখনও নানা এলাকা থেকে ‘প্রতিরোধ’ কর্মসূচি নেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন নিচুতলার কর্মীরা। তাই হিসেব চাওয়া হয়েছে, কতগুলি বুথ সন্ত্রাস কবলিত? সেখানে দলের কী কী কাজ করা যাচ্ছে বা যাচ্ছে না? সন্ত্রাস মোকাবিলার জন্য কী কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে? জেলা কমিটির এক সদস্য বলেন, “নিচুতলার কর্মীদের মধ্যে প্রতিরোধের মানসিকতা তৈরি হয়েছে কি না বুঝেই দল সেই মতো কর্মসূচি নেবে।”
তবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে নিচুতলা থেকে ঠিকঠাক খবর পাওয়ার বিষয়টিই। সিপিএম সূত্রের খবর, গত লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনে নিচুতলা থেকে জেলা নেতৃত্ব মারফত আসা ‘ভুল’ তথ্যে ভর করেই অনেকখানি নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলেন আলিমুদ্দিনের নেতারা। অবস্থা কতটা খারাপ, রাজ্য নেতৃত্ব তা আন্দাজই করতে পারেননি। কিন্তু শুধুই কি বর্ধমানের নিচুতলাকে চিঠি দিলে হবে? মদনবাবু বলেন, “লোকসভা নির্বাচনের আগে সমস্যা মোকাবিলার জন্য এক-একটি জেলা নিজের মতো করে লোকাল নেতা-কর্মীদের পরামর্শ নিচ্ছে। আমাদের দলে এমন হয়।” |