চার রাজ্যে ভোটের ফল দেখে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি এ বার নিঃশব্দে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার জমি তৈরি করে রাখতে চাইছে। তারা মনে করছে, কংগ্রেসের ডুবন্ত নৌকায় সওয়ার হয়ে লাভ নেই। অন্য দিকে, বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদীর ছায়াও দীর্ঘতর হচ্ছে। এখন উন্নয়নের কথা বললেও সাম্প্রদায়িক তকমাটি যাঁর এখনও মোছেনি।
এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে জোট নিয়ে কোনও ঘোষণা করার পথে না হেঁটে আঞ্চলিক দলগুলি আপাতত পারস্পরিক সম্পর্কগুলিকে ঝালিয়ে নিতে চায়। যেমন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের ফল নিয়ে আজ কোনও প্রতিক্রিয়া না দিলেও আগামী কাল তিনি দিল্লিতে আসছেন। তৃণমূল জানিয়েছে, কেন্দ্রের আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে দলের সাংসদরা কাল সংসদ চত্বরে গাঁধী মূর্তির পাদদেশে ধরনায় বসবেন। মমতার সফরের কর্মসূচি নিয়ে কোনও ঘোষণায় যেতে চাইছেন না তৃণমূল বা তাঁর নেত্রী। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না এই সফরে রাজনৈতিক দলগুলি সঙ্গে জনসংযোগ বাড়ানোই তাঁর লক্ষ্য।
তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের কথায়, “বর্তমান লোকসভার এটাই শেষ পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর সদস্য ছিলেন। তাই সৌজন্য বিনিময় করতে আসছেন তিনি।” দলের রাজ্যসভার মুখ্য সচেতক ডেরেক ও’ব্রায়ান বলেন, “দলনেত্রী কাল আসছেন। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন ও শান্তিই তাঁর লক্ষ্য। তাঁর ভিত্তিতেই আমরা ভাল নম্বর পাব। ভবিষ্যতে নম্বরই কথা বলবে।”
রবিবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে জয়ন্তী নটরাজন ও অরুণ জেটলির উপস্থিতিতে কংগ্রেস-বিজেপি উভয় দলকেই নিশানা করে ডেরেক বলেন, এই নির্বাচনে দু’টো জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেল। এক, কংগ্রেস ধুয়েমুছে গিয়েছে। দুই, যে ভাবে মোদী ঝড়ের কথা বলা হচ্ছিল, বাস্তবে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। আগামী লোকসভায় কোন ইঞ্জিন ট্রেনটা চালাবে সেটা এখনই স্পষ্ট। অ-কংগ্রেসি অ-বিজেপি ইঞ্জিন। এ দু’টি দলের বিকল্প পেলে মানুষ যে তাদের উপরেই আস্থা রাখবে, দিল্লিই তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
এই বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার কথা অনেক দিন ধরেই বলছেন মমতা। অক্টোবরের শেষে আঞ্চলিক দলগুলিকে নিয়ে ‘পিপলস ফেডারেল অ্যালায়েন্স’ গড়ার ডাক দিয়েছিলেন তিনি। তার আগে ইউপিএ সরকারের দ্বিতীয় দফাতে তেলের দাম বৃদ্ধি থেকে এনসিটিসি গঠন কেন্দ্রের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে মমতার নেতৃত্বে একটি ছাতার তলায় এসে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন নীতীশ কুমার, নবীন পট্টনায়ক, মুলায়ম সিংহরা। এ ছাড়া মমতা বরাবরই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জয়ললিতা, অখিলেশ যাদব, নবীনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। এখন ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন অন্ধ্রপ্রদেশের দাপুটে আঞ্চলিক শক্তি ওয়াইএসআর কংগ্রেস নেতা জগন্মোহন রেড্ডির সঙ্গে।
জাতীয় ও বাংলার রাজনীতি, দু’ভাবেই এটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা জগন্মোহন কংগ্রেসের বিদ্রোহী মুখ এবং রাজ্য ভাগের বিরোধী। আঞ্চলিক কংগ্রেস নেতৃত্ব মাথা তুলতে গেলেই কংগ্রেস হাইকম্যান্ড তাকে ছেঁটে ফেলে বলে যে অভিযোগ দশ জনপথের বিরুদ্ধে রয়েছে, জগন্মোহন তার বড় উদাহরণ।
কংগ্রেসেরই একাংশ মনে করে জগন্মোহনকে সামনে রেখে এগোলে অন্ধ্রে দল ভাল করতে পারত। কিন্তু তা না করে, হাইকম্যান্ডের হাতের পুতুল কিরণ রেড্ডিকে নেতা করে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে চাইছে। এহেন জগন্মোহন ২০ নভেম্বর কলকাতায় গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। দার্জিলিং নিয়ে ভুক্তভোগী মমতা অন্ধ্র ভাগের কট্টর বিরোধী এই নেতার পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছেন।
পরশু অন্ধ্র ভাগের বিলটি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পাশ হওয়ার পর দিনই জগন্মোহন অখিলেশ যাদবের সঙ্গে দেখে করে তাঁদের সমর্থন আদায় করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি যে মমতা দিদির কাছেও ছুটে গিয়েছিলেন সে কথাও উল্লেখ করেন জগন্মেহন।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় র্যজ্যগুলির স্বার্থ রক্ষা ও আঞ্চলিক দলগুলির অধিকার পূরণের লক্ষ্যে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ফ্রন্ট গঠন মমতার পুরনো কর্মসূচি। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে তা কী ভাবে এগোয়, এ বার সে দিকেই নজর রাখতে চাইছে রাজনৈতিক দলগুলি।
লোকসভা ভোটের এখনও কয়েক মাস বাকি। এই সময়টুকুকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে তৃতীয় বিকল্পের সম্ভাবনা যাচাই বা জমি তৈরি করতে চাইছেন আঞ্চলিক নেতারা। সমাজবাদী পার্টির নেতা নরেশ অগ্রবালের ব্যাখ্যা, “কংগ্রেসের এই মুহূর্তে যা পরিস্থিতি তাতে তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে লোকসভা নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। আবার এটাও ঠিক যে বিজেপি মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার ফলে দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জের সামনে পড়েছে। তবে লোকসভা নির্বাচনের দেরি আছে। এখনই জোট হবে কি না, তা বলা সম্ভব নয়। ভোটের ফলাফল বেরোক। তার পর পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।” নরেশ জানাচ্ছেন, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে তাঁর দল।
একই ভাবে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী তথা বিজু জনতা দলের নেতা নবীন পট্টনায়কের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখে এগোচ্ছেন মমতা। ভোটের ফল দেখে বিজেডি-র সাংসদ তথা মুখপাত্র ভ্রাতৃহরি মাহতাব বলেছেন, “অ-কংগ্রেসি এবং অ-বিজেপি শক্তিগুলির একত্রিত হওয়ার প্রয়োজন বাড়ছে। দু’টি জাতীয় দলের নীতিতেই মানুষ বীতশ্রদ্ধ। এটাই তৃতীয় বিকল্প তৈরি করার আদর্শ সময়।” মমতা কাল দিল্লি আসার পর তাঁর সঙ্গে বিজেডি কথা বলতে চায় বলে জানিয়েছেন মাহতাব।
|