|
|
|
|
জল মাপতেই এ বার দিল্লি পাড়ি মমতার |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি
৭ ডিসেম্বর |
শেষ বার দিল্লি এসেছিলেন যোজনা কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করতে। সে বারই কমিশনের দফতরের বাইরে তাঁকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল এসএফআই। যা নিয়ে রাজনৈতিক জলঘোলা হয়েছিল বিস্তর। তার পর আগামী সোমবার ফের দিল্লির মাটিতে পা রাখতে চলেছেন তিনি। তার মানে কি রাজনীতির এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে?
“কোনও অধ্যায়-টধ্যায় নেই।” প্রশ্ন শুনেই সপাটে উড়িয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। “ব্যক্তিগত কিছু কাজ আছে। তা ছাড়া, এত দিন সংসদে ছিলাম। দিল্লি গেলে অনেকের সঙ্গে দেখা হয়।”
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সফরকে যতই লঘু করে দেখাতে চান না কেন, শাহি দিল্লি কিন্তু রাজনৈতিক তাৎপর্যের গন্ধ পাচ্ছে। বিশেষ করে পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের পরের দিনই মমতা দিল্লি আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ায়।
ভোটের ফল আগামিকাল দুপুরের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। কংগ্রেসের পক্ষে আশার খবর শোনায়নি প্রায় কোনও বুথ-ফেরত সমীক্ষাই। বস্তুত, দশ বছর দেশ শাসনের পরে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে একটা হাওয়া উঠেছে, সেটা আমদরবারে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। ফলে আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে অঙ্কটা কী হবে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে এখন থেকেই।
দিল্লিতে গণতন্ত্রের শক্তি মাপা হয় সাংসদের সংখ্যায়। কংগ্রেস এবং বিজেপি, দু’পক্ষেরই যদি সংখ্যায় টান ধরে তা হলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে আঞ্চলিক দলগুলির ভূমিকা। আর সিপিএম এবং কংগ্রেস রাজ্যের দুই বিরোধী দলই যে হেতু মনে করছে এ বার তৃণমূলের আসন বৃদ্ধির সম্ভাবনা প্রবল, সে হেতু দিল্লিতে টালমাটাল পরিস্থিতিতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারেন মমতা। সেই সম্ভাবনা থেকেই মমতার সফর ঘিরে তাৎপর্যের গন্ধ পাচ্ছেন অনেকে।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি যদি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তা হলে মমতা কি এনডিএ-তে ফিরে যেতে পারেন? হাওড়া লোকসভা উপনির্বাচনে প্রার্থী না-দিয়ে সেই জল্পনা উস্কে দিয়েছিলেন বিজেপি সভাপতি রাজনাথ সিংহ। কিন্তু বরুণ গাঁধী দলের তরফে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব নেওয়ার পরে রাজ্য সভাপতি রাহুল সিন্হার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব নিয়েছেন।
এনডিএ-তে সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্বও। রাজ্যের তিরিশ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের বেশির ভাগই এখন তৃণমূলের দিকে। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা বিজেপি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই ভোট খোয়াতে চায় না তারা। ডেরেক ও’ব্রায়েনের মতো তৃণমূল সাংসদ তাই সাফ বলে দিচ্ছেন “এনডিএ? নৈব নৈব চ।” তৃণমূল নেতারা মনে করাচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণ সত্ত্বেও তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেননি মমতা। মোদী কলকাতায় এসে দেখা করতে চাওয়া সত্ত্বেও দেখা করেননি।
এর বিপরীতে খবর হল, আজ শনিবার দিল্লির জামা মসজিদের শাহি ইমাম সৈয়দ বুখারির ছেলের বিয়েতে আমন্ত্রিত ছিলেন মমতা। নিজে আসতে না-পারলেও মুকুল রায় এবং ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে পাঠিয়েছেন মমতা। সঙ্গে উপহার সোনার গয়না। আগামী সপ্তাহে দিল্লি এসে মমতা যাতে নবদম্পতিকে আর্শীবাদ করে যান, সেই অনুরোধও জানিয়েছেন বুখারি।
বিজেপি যদি অচ্ছুৎ হয়, তা হলে তাঁর পুরনো কর্মসূচি ফেডেরাল ফ্রন্ট (ইদানীং যাকে তিনি অবিহিত করছেন ইউনাইটেড ইন্ডিয়া ফ্রন্ট বলে) গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতেই কি মমতার এ বারের দিল্লি-যাত্রা? এই ফ্রন্ট গড়ার ব্যাপারে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের সঙ্গে একটা সময় আলোচনা শুরু করছিলেন মমতা। কিন্তু নীতীশ এনডিএ ছাড়ার পরে কংগ্রেসের সঙ্গে গোপন বোঝাপড়া শুরু করায় তিনি এই প্রক্রিয়া থেকে খানিকটা দূরে সরে যান। এর পরে দিল্লিতে বামেদের আয়োজিত সমাবেশে যোগ দেন নীতীশ। ফলে মমতার সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়ে।
তবে অন্ধ্রপ্রদেশের জগন্মোহন রেড্ডি, যাঁর নির্বাচনী ভবিষ্যৎ ভাল বলে মনে করছেন কংগ্রেস নেতারাই, সম্প্রতি কলকাতায় এসে মমতার সঙ্গে দেখা করেছেন। তাঁর সঙ্গে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সাক্ষাতের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন মমতাই। মমতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও। মুলায়ম যতই সিপিএমের সঙ্গে ওঠাবসা করুন না কেন! মুকুল রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন মায়াবতীর প্রতিনিধি সতীশ মিশ্র। ফলে স্তিমিত হলেও ফেডেরাল ফ্রন্ট গড়ার উদ্যোগ যে জলে গিয়েছে, এমন নয়। প্রশ্ন হল, পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের ভূমিকা কী হবে? মমতার সঙ্গে কি তাঁরা সংঘাতের পথে যাবে? সারদা-কাণ্ডের সিবিআই তদন্ত নিয়ে তৎপর হবে। তৃণমূলকে বিপাকে ফেলতে উস্কে দেবে কুণাল ঘোষকে? কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারাই বলছেন, আসন সংখ্যা যদি কমে, তা হলে দলের দাদাগিরি করার ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে লোকসভায় আসন সংখ্যা কমার আশঙ্কা সামনে রেখে কংগ্রেসের পক্ষে কতটা আক্রমণাত্মক হওয়া সম্ভব, সেই প্রশ্ন থাকছেই। তা ছাড়া, তখন এক দিকে যেমন লোকসভা ভোটের পরে তৃণমূলের সমর্থন নেওয়ার সম্ভাবনার কথা মাথায় রাখতে হবে কংগ্রেস নেতাদের, তেমনই বিজেপি-কে ঠেকাতে প্রয়োজনে আঞ্চলিক দলগুলির জোট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দেওয়ার জন্যও তৈরি থাকতে হবে।
তৃণমূল অবশ্য কংগ্রেস বিরোধিতার হাওয়া তৈরি হয়েছে বুঝে তাদের সঙ্গে সমঝোতার ভাবনাকে আমল দিচ্ছে না। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেন, “কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বেঁধে লোকসভায় লড়ার তাগিদ নেই। কারণ তৃণমূল একাই বিপুল ভোটে জিতবে। তা ছাড়া, কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও এমন কোনও প্রস্তাব নেই। কাজেই বিবেচনার প্রশ্নও উঠছে না।”
তৃণমূলের মতে, জোট হলে তাঁদের যত না লাভ হবে, কংগ্রেসের লাভ তার চেয়ে বেশি। কারণ, পঞ্চায়েত থেকে পুরসভা রাজ্যের সব ভোটেই বামেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অবস্থা খারাপ কংগ্রেসের। তাই রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের বঞ্চনার অভিযোগ, বাম-কংগ্রেস আঁতাঁত নিয়ে প্রচার করে এক অস্ত্রে দুই শত্রু মারতে চাইছেন মমতা। এ বারের দিল্লি সফরে সনিয়া গাঁধী, রাজনাথ সিংহের সঙ্গে যেমন জোট নিয়ে কথা বলবেন না মমতা, তেমনই ফেডেরাল ফ্রন্ট নিয়ে কথা বলবেন না মুলায়ম-মায়াবতী-জয়ললিতা-করুণানিধির সংসদীয় দলের নেতাদের সঙ্গে। তা হলে এই সফরের তাৎপর্য কোথায়!
রাজধানীর রাজনীতিকরা মনে করছেন, লোকসভা ভোটের মুখে জাতীয় রাজনীতির জল মাপাটাই মূল লক্ষ্য মমতার। বুঝে নেওয়া আঞ্চলিক দলের নেতারা কে কোন অবস্থানে আছেন। কংগ্রেসের অবস্থা কতটা খারাপ। মোদীর পক্ষে হাওয়াই বা কতটা। বস্তুত শুধু মমতা নন, সব নেতাই এখন এই কাজে ব্যস্ত। সব দলের মাথারাই স্বীকার করছেন, এটা মুক্ত জনসংযোগের সময়। সকলেই সকলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। আর তার থেকেই তৈরি হবে ভবিষ্যতের জোট-চিত্র। দিল্লি প্রতীক্ষায়।
|
পুরনো খবর: পরশু দিল্লিতে মমতা, ডাক মঞ্চ থেকেও |
|
|
|
|
|