|
|
|
|
রাহুলের বিরুদ্ধে চোরা ক্ষোভ, দলের রাশ ধরবেন কি সনিয়া |
শঙ্খদীপ দাস • নয়াদিল্লি
৮ ডিসেম্বর |
দশ নম্বর জনপথ থেকে যখন বেরোলেন, আনত মুখ। শরীরের ভাষাই জানান দিচ্ছে, তিনি বিধ্বস্ত। তবু কতকটা জোর করেই মুখে হাসি টেনে আনলেন রাহুল গাঁধী। তার পর সংবাদমাধ্যমের সামনে এগিয়ে দিলেন মা সনিয়া গাঁধীকে।
প্রার্থী বাছাই থেকে শুরু করে প্রচারকৌশল নির্ধারণ সবই হয়েছে রাহুলের নেতৃত্বে। দলে ঝাড়াইবাছাই যা হয়েছে, তা-ও করেছেন তিনিই। কিন্তু পরাজয়ের পর সামনে আনতে হল সেই সনিয়াকেই। খাদের ধারে চলে যাওয়া কংগ্রেসকে দশ বছর আগে যিনি টেনে তুলেছিলেন ক্ষমতার আসনে। শুধু তাই নয়। গত কয়েক মাসে যে বর্ষীয়ানদের রাহুলের আশেপাশে, এমনকী কংগ্রেস দফতরের চৌহদ্দিতেও বিশেষ দেখা যায়নি, আজ সনিয়ার পাশে ফের তাঁরাই।
তা হলে কি আপনি ফেল করলেন?
রাহুল বললেন, “আমি পাশ করেছি না ফেল, তা আপনারা বিচার করুন। আমি আমার কাজ করেছি।”
এ-ও বললেন, এই ভোটের বার্তা তিনি ‘দিল’ এবং ‘দিমাগ’ দুই দিয়েই বুঝেছেন। তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতে দলে বদলও আনবেন। কী ধরনের বদল? এই ব্যর্থতার পর সহ-সভাপতির পদ ছাড়বেন কি? জবাব এল না।
ঘরোয়া আলোচনায় বর্ষীয়ান নেতারা কিছুটা খেদ নিয়েই বলছেন, রাহুল ফেল করলেই বা কী করার আছে? তাঁকে তো ফেলে দিতে পারবে না কংগ্রেস। আর তাই বিপর্যয়ের আগুন থেকে রাহুল গাঁধীর ছবিকে বাঁচাতে আজ নিজের দলকেই কৌশলী আক্রমণ করতে বাধ্য হয়েছেন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির নেতা জনার্দন দ্বিবেদী। বলেছেন, “গোষ্ঠী কোন্দলের জন্যই হেরেছি চার রাজ্যে। এত খেয়োখেয়ি হলে জিতব কী ভাবে?” |
|
ফেল না পাশ! বিপর্যয়ের দায় এড়াতে পারেন না তিনি। তবু তাঁকেই
প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করতে পারে দল। রবিবার পিটিআই-এর ছবি। |
তা ছাড়া এখন যা পরিস্থিতি, তাতে ভোটের আগেই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে দিতে পারে কংগ্রেস। সনিয়া নিজে আজ সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী কে হবেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “চিন্তা করবেন না। নামটা ঠিক সময়ে জানিয়ে দেওয়া হবে।” দলের অনেকেই মনে করছেন, আজকের ফলাফলের পরে মোদীর বিরুদ্ধে একটা নাম ঘোষণা না-করে ছায়াযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উপায় আর নেই বললেই চলে। ফলে সেই দিকে তাকিয়েও রাহুলকে বাঁচানোর তাগিদ রয়েছে দলে। কিন্তু প্রকাশ্যে গাঁধী পরিবারের গরিমা রক্ষার দায় মেটানোর পরেই তলে তলে রাহুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন একাধিক নেতা। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য, “যে পন্থায় দল পরিচালনা করছেন রাহুল, তা দিয়ে এনজিও চালানো যায়। ভোট জেতা যায় না।”
কংগ্রেস নেতৃত্বের এই বোধোদয় আজ হল, এমন নয়। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক সদস্যের কথায়, সাম্প্রতিক কালে একাধিক রাজ্য নির্বাচন দেখিয়ে দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় মজবুত আঞ্চলিক নেতা ছাড়া জেতা সম্ভব নয়। অতীতে বিধানচন্দ্র রায়, কামরাজের মতো শক্তিশালী আঞ্চলিক নেতা কংগ্রেসে ছিলেন। কিন্তু হাইকম্যান্ড-সংস্কৃতি যবে থেকে দলের মাথায় চেপেছে, তখন থেকেই আঞ্চলিক শক্তিকে খতম করার একটা চেষ্টা চলেছে। রাজশেখর রেড্ডির মতো দাপুটে নেতাকে বিব্রত করতে উস্কে দেওয়া হয়েছে কেশব রাওকে। প্রবল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও ছেঁটে ফেলা হয়েছে জগন্মোহন রেড্ডিকে। ফলে রাজ্যে রাজ্যে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়েছে কংগ্রেস। মধ্যপ্রদেশে যদি প্রথম থেকেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হত, তাহলে এতটা ভরাডুবি হত না। একই ভাবে সি পি জোশীকে না পাঠিয়ে অশোক গহলৌতকে শান্তিতে থাকতে দিলে রাজস্থানে উলুখাগড়ার মতো উড়ে যেত না কংগ্রেস। ছত্তীসগড়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজিত জোগীর জন্যও একই কথা।
কংগ্রেস নেতৃত্বের মতে, শুধু রাহুল নন, সনিয়াকেও এখন এই প্রয়োজনীয়তাটা দিল ও দিমাগ দিয়ে বুঝতে হবে। রাহুল শিবিরের নেতারা অবশ্য বলছেন, কোনও এক জনকে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী হিসাবে তুলে ধরলে গোষ্ঠী কোন্দল বাড়তে পারত! কিন্তু অন্য মতটা হল, হাইকম্যান্ড বিক্ষুব্ধদের প্রশ্রয় না দিলে তারা বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারত না।
এখানেই শেষ নয়। গুজরাতের প্রাক্তন সাংসদ মধুসূদন মিস্ত্রীকে রাতারাতি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করে প্রার্থী বাছাইয়ের মূল দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাহুল। ভরাডুবির পর এখন জনার্দন দ্বিবেদীরা বলছেন, “কে মধুসূদন? মধ্যপ্রদেশের ঝিন্দে কংগ্রেসের কে প্রার্থী হবেন, তা ঠিক করবেন গুজরাতের নেতা?” মোতিলাল ভোরাদের মতে, রাহুল বর্ষীয়ানদের দূরে সরিয়ে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মকে যে ভাবে দায়িত্ব দিতে চাইছেন, তাতে অসুবিধা নেই। কিন্তু যে নেতারা জমিতে কাজ করছেন, তাঁদের বাদ দিয়ে এমন সব নেতাকে তুলে আনছেন, যাঁদের রাজ্যওয়াড়ি পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই। উত্তরপ্রদেশ এবং গুজরাতে ভরাডুবির পরেও এ বার মধ্যপ্রদেশ নির্বাচনের জন্য মোহন প্রকাশকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাহুল। ফলটা দেখাই যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হল, এ বার সনিয়া গাঁধী কী করবেন? আগামী কাল তাঁর জন্মদিন। মুখে বলছেন, “লোকসভা ভোটের বিষয়টা অন্য রকম।
বিধানসভা ভোটের সঙ্গে তার
কোনও সম্পর্ক নেই,” কিন্তু চিন্তার ভাঁজ পড়ছে কপালে।
আজ থেকে প্রায় এক বছর আগে জয়পুরে দলের চিন্তন শিবিরে রাহুলকে সহ-সভাপতি পদে বসিয়েছিলেন সনিয়া। কিন্তু এখন তাঁর কাছেও পরিষ্কার যে, রাহুলের বিরুদ্ধে কার্যত অসন্তোষের চোরাস্রোত বইছে দলে। এই অবস্থায় সনিয়া মুখে বলেছেন, “কেন এই হার হল, তা গভীর ভাবে সমীক্ষার প্রয়োজন।” কিন্তু একাধিক কংগ্রেস নেতা বলছেন, এই ভরাডুবির পর সনিয়ার পক্ষে স্বাভাবিক ভাবেই আর মুখ ফিরিয়ে থাকা সম্ভব নয়। রাহুলের একার হাতে দলকে ছাড়াও সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁদের আশঙ্কা, সনিয়া কী করবেন, সেটা হয়তো তিনি নিজেও বুঝে উঠতে পারছেন না। কেননা চার রাজ্যে বিপর্যয়ের পর দলের মনোবল চুরমার হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন করে টিম গঠনের চেষ্টা করতে পারেন সনিয়া। কিন্তু দু’মাসের মধ্যে তাঁরা কীই বা জাদু দেখাবেন!
তা ছাড়া লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস কোন দিশায় প্রচার করবে, তা নিয়েও সনিয়া সংকটে রয়েছেন বলে মনে করছেন অনেকে। কারণ খাদ্য সুরক্ষা, জমি বিলের মতো সামাজিক সুরক্ষার বিষয়গুলি নিয়ে ভোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী। কিন্তু রাজস্থান ভোটে দেখা গেল, সামাজিক সুরক্ষায় জলের মতো টাকা ঢেলেও লাভ হয়নি। আজ সনিয়া নিজেও স্বীকার করেছেন, “রাজস্থানে এত জনকল্যাণ কর্মসূচি সত্ত্বেও কেন পরাজয় হল, ভেবে দেখতে হবে। আমাদের কথা নিশ্চয় মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়নি।”
|
পুরনো খবর: ঘরে-বাইরে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ‘ওয়ার-রুমে’ বৈঠক |
|
|
|
|
|