শূন্য থেকে অলৌকিক উত্থান এক আম আদমির
বিটা যত না পুরনো, তার সংলাপের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার সুবাদে ইংরেজি শব্দবন্ধটা তার চেয়েও বেশি জীর্ণ ইতিমধ্যেই। তবুও দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে জনৈক অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁর দলের ভোজবাজির মতো উত্থানের আবহে ফের ব্যবহার করতে হয় সেই শব্দবন্ধটাই।
‘স্টুপিড কমন ম্যান’।
ছবির নাম ‘আ ওয়েডনেসডে’। ‘কমন ম্যান’ নাসিরুদ্দিন শাহ ফোনে পুলিশ কমিশনার প্রকাশ রাঠৌর, তথা অনুপম খেরকে বলছেন, “আপ জ্যায়সে লোগ ইন কীড়ো কা সাফায়া নেহি করেঙ্গে, তো হামে ঝাড়ু উঠানি হোগি”, আপনারা (সমাজের) এই সব পোকামাকড়কে যখন তাড়াবেন না, তখন আমাদের তো ঝাড়ু হাতে নিতেই হবে।
সিনেমা আর বাস্তবে এত মিল হয় নাকি! রবিবার ভারতের রাজধানীতে ‘আম আদমি পার্টি’র ঝাড়ু শেষ অবধি এমন দাপট দেখিয়েছে, যে শাসক কংগ্রেস ধুয়েমুছে সাফ। একক বৃহত্তম দল বিজেপির থেকেও মাত্র চারটে আসন পিছনে দৌড় শেষ করেছে ওই জনৈক কেজরিওয়ালের দল। যে দলের জন্মই মাত্র এক বছর আগে। যে দলের প্রধান কেজরিওয়ালের কাছে ২৫ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত! ভোটের ত্রিমুখী লড়াই আগেও দেখেছে দিল্লি। ১৯৯৩ সালে জনতা দল কিংবা ২০০৮ সালে বহুজন সমাজ পার্টিও থাবা বসিয়েছিল কংগ্রেস ও বিজেপির ভোট বাক্সে। কিন্তু এ তো একেবারে ঝড়!
কেজরিওয়ালের কেরামতিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কেউ কেউ বলছেন শূন্য থেকে উঠে আসা এক অজ্ঞাতকুলশীলের জয়।
আম আদমির গেরস্থালি। গাজিয়াবাদের বাড়িতে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মা-বাবা। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা।
সত্যিই তো! কে তিনি? তথ্যের অধিকার আন্দোলন কর্মী, ম্যাগসাইসাই-জয়ী। সরকারি চাকরি ছেড়ে স্বেচ্ছায় সমাজকর্মী। অণ্ণা হজারে যখন জনলোকপাল বিলের দাবিতে অনশন-আন্দোলন শুরু করলেন, কেজরিওয়াল তখন ওই ‘ইন্ডিয়া এগেন্সট করাপশন’ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। জনলোকপাল নিয়ে দিল্লি জুড়ে তুমুল আলোড়ন বেশ কিছু দিন চলার পর এক সময়ে স্তিমিত হল। তার পর এক দিন দেখা গেল অণ্ণার আপত্তি সত্ত্বেও কেজরিওয়াল স্থির করেছেন ভোটে লড়তেই হবে। তৈরি হল আম আদমি পার্টি। মোটামুটি সেই সময় ইস্তক বলা যেতে পারে, কিছুটা নিয়মিত খবরে আসতে লাগলেন কেজরিওয়াল। এই বিদ্যুতের বাড়াবাড়ি দাম নিয়ে অনশন আন্দোলন করছেন, তো এই নারীদের সুরক্ষার দাবিতে সুর চড়াচ্ছেন।
কিন্তু তার বাইরে? কে তিনি? ওই যে আম আদমি। কমন ম্যান। কেজরিওয়ালের নিজের কথায়, “বিজেপি, কংগ্রেস ও মুষ্টিমেয় কিছু দলের হাতে আমাদের দেশের রাজনীতি জাত, ধর্ম, ভ্রষ্টাচার, অপরাধ, ধনবল, বাহুবলের গোলাম হয়ে পড়েছিল। সাধারণ মানুষের বাঁচা মুশকিল হয়ে পড়েছিল। তাই জনতা সিদ্ধান্ত নেয়, তাকেই এ বার ভোটে লড়তে হবে।”
সেই সিদ্ধান্তের ফল হাতেনাতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু রহস্যটা কী? দিল্লির মতো চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক এক শহরে কোন মন্ত্রবলে এই অসাধ্যসাধন করলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল?
দিল্লির রাজনীতির আঙিনায় যাঁরা ঘোরাফেরা করেন, তাঁরা একটি সহজ-সরল ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি, নিরাপত্তার অভাব এমন নানাবিধ কারণে শাসক/বিরোধী নির্বিশেষে সমস্ত বড় রাজনৈতিক দলের উপর তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিল আমজনতার একটা বড় অংশ। এই অংশটা মূলত মধ্যবিত্ত অথবা নিম্ন-মধ্যবিত্ত। যাঁরা সবথেকে বেশি করে ‘সিস্টেমের’ শিকার। অটোওয়ালা-সব্জিওয়ালা থেকে শুরু করে তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। এ বারের ভোটে কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টিকেই তাঁরা বেছে নিয়েছেন জমা ক্ষোভ উগরে দেওয়ার মঞ্চ হিসেবে।
পুঞ্জীভূত জনরোষের হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটলে কী হতে পারে, নির্ভয়া-কাণ্ডের সময়েই তার প্রমাণ পেয়েছিল রাজধানী। রাজপথে জলকামানের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে পড়েছিল আম দিল্লিবাসী। কেউ কেউ এমনও বলছেন, বারুদের স্তূপে স্ফুলিঙ্গ ছিল নির্ভয়ার ঘটনা। সেই ঘটনা-পরবর্তী চেন-রিঅ্যাকশনের একটা পর্যায়ই হল আম আদমি পার্টির আজকের জয়।
যদিও ব্যক্তি কেজরিওয়ালকেও যথেষ্ট গুরুত্বই দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁর সৎ ভাবমূর্তি, বিদ্যুতের বাড়তি বিল কিংবা রেশন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই নিঃসন্দেহে লোকের মন টেনেছিল। মনে রাখতে হবে, এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় কেজরিওয়াল তাঁকে পত্রপাঠ সরিয়ে দিয়েছিলেন নির্বাচনী ময়দান থেকে। কিন্তু সব চেয়ে যেটা বড় কথা, এ বারের ভোটের আগে আম আদমির টিম এই কথাটি জনতাকে বোঝাতে যথেষ্ট সফল হয়েছে যে, কংগ্রেস বা বিজেপি ক্ষমতায় এলে বর্তমান সামাজিক অবস্থাটা বদলাবে না। অতএব ‘পাল্টাও সব কিছু’। সেই ডাকেই অভাবনীয় সাড়া মিলেছে।
অথচ কেজরিওয়ালের পার্টির সম্বল কী ছিল? অর্থবল তেমন নয়। চাঁদা নিয়েছেন ততটুকুই, যতটুক দরকার। জমা-খরচের সে হিসেব রয়েছে ওয়েবসাইটে। লোকবলও নেই। কেজরিওয়াল গণ-এসএমএস করে জনতার কাছে আর্জি জানিয়েছেন, “এটা আপনাদের লড়াই। দুর্নীতির সঙ্গে সততার লড়াই। আমাদের দলীয় কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসুন।” স্মরণকালে এমন ভাষায় আর্জি কি কোনও রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে পেয়েছেন এ দেশের ভোটদাতারা?
কাজেই অবিশ্বাস্য শোনায় না, যখন বেশ কিছু চাকরিজীবী ভোটের আগে অফিস কামাই করে আম আদমি পার্টির প্রচারে পড়ে থাকেন। স্বেচ্ছাশ্রম দিতে চলে আসেন কিছু অনাবাসী ভারতীয়। বিনোদনগর কেন্দ্রে মুখচেনা সম্পন্ন গৃহবধূ ভোট দিয়ে বেরিয়ে এসে দৃপ্ত গলায় বলেন, “ভোটটা ‘আপ’-কেই দিলাম। অনেক হয়েছে। এ বার আমাদের পরিবর্তন চাই।” হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্তর গণ্ডি পেরিয়ে সম্পন্ন শ্রেণির চৌকাঠেও পৌঁছে গিয়েছিল আম-আদমির ঢেউ। ৪১ হনুমান রোডে আম আদমির অস্থায়ী দফতরের সামনের ভিড়ে আজ দেখা মিলেছে সেই তথাকথিত ‘সবেতেই নির্লিপ্ত এলিট’ সমাজের অনেকের। হাতে প্রতীকী ঝাঁটা, মুখে আবির। উজ্জ্বল চোখ-মুখই বুঝিয়ে দিচ্ছে অনুচ্চারিত হলেও এ লড়াইয়ে তাঁদের সমর্থনও কিছু কম ছিল না।
সকাল সাড়ে ছ’টা থেকেই ভিড় জমছিল হনুমান রোডে। তবে তখন কিছুটা চাপে ছিলেন নেতারা। কারণ, বুথফেরত সমীক্ষার ফল তো আশাপ্রদ ছিল না। সকাল সাতটার মধ্যে কার্যালয়ে নিজেকে বন্দি করে ফেলেন কেজরিওয়াল। নিজে সামনে না এলেও প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর নির্বাচনের ফলাফল জানানোর ভার দেওয়া হয় দলীয় নেতা কুমার বিশ্বাসকে। তার পর দিল্লির মুখ থেকে কুয়াশার চাদর যত সরেছে, তাল মিলিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ‘আপ’-এর কর্মী-সমর্থকদের চেহারাও। সাড়ে ন’টা, সাড়ে দশ’টা, দেড়টা মাইক যত বার সচল হয়েছে, তত জয়ের উচ্ছ্বাসে গা ভাসিয়েছে আম আদমি।
সাতসকালের ঠান্ডাকে পাত্তা না দেওয়া ওই ভিড়েই ছিলেন জেএনইউয়ের বছর একুশের ছাত্রী অনন্যা। বললেন, “মনে হচ্ছে একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। দিল্লি সরকার যে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল, মানুষ আজ তার জবাব দিল।”
অনেক দূরে গাজিয়াবাদের কৌশম্বী এলাকার গিরনার আবাসনের একটি দু’কামরার ফ্ল্যাটে তখন এক বৃদ্ধ দম্পতি টিভির সামনে বসে। পর্দায় প্রতি মুহূর্তে ফলাফল বদলাচ্ছে, আর বদলে যাচ্ছে দম্পতির অভিব্যক্তি। বরাবরই ধরাবাঁধা গণ্ডির বাইরে থেকেছেন অবসরপ্রাপ্ত ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার গোবিন্দ রামের বড় ছেলে অরবিন্দ। সেই তিনিই কি না এ বার দিল্লি দখলের লড়াইয়ে সামিল। ফলে সকাল থেকেই টেনশনে ছিলেন বাবা-মা। প্রথম দু’ফায় হেভিওয়েট প্রার্থী শীলা এগিয়ে থাকলেও পঞ্চম রাউন্ডের পর থেকেই আবাসনের ছেলের জয়ের গন্ধ পেয়ে হাজির পড়শিরা। অভিনন্দনের বন্যায় ভাসতে ভাসতে মায়ের চিন্তা, জিতলে প্রিয় খাবার ‘কারি-চাউল’ খাবে বলে আবদার ধরেছিল ছেলে। কিন্তু সময় বার করতে পারবে তো? যাঁর সঙ্গে মতপার্থক্যের পর তাঁর ছেলের রাজনীতিতে প্রবেশ, সেই অণ্ণা হজারে তত ক্ষণে বলে দিয়েছেন, “আমি মনে করি অরবিন্দ এক দিন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হবে।”
আর অরবিন্দ নিজে কী বলছেন? বলছেন, “এই ভোটের ফল থেকে শিক্ষা নিক রাজনৈতিক দলগুলি। প্রথমে মুম্বই। তারপর আমরা সারা ভারত থেকে লড়ব।”
ফের ‘আ ওয়েডনেসডে’। নাসিরুদ্দিন বলছেন, “লোগোমে গুস্সা বহুত হ্যায়, উনহে আজমানা (পরখ করা) বন্ধ কিজিয়ে।”
জনরোষের পরীক্ষা নেবেন না। অরবিন্দ অবশ্য হুঁশিয়ারি দিয়েই থামলেন না। কাজে করেও দেখালেন!

পুরনো খবর:


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.