|
|
|
|
ভুলে ভরা নীতিতেই ভরাডুবি কংগ্রেসের |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি
৮ ডিসেম্বর |
একেই বোধ হয় বলা হয় কর্মফল!
ইউপিএ-সরকারের গত দশ বছরের প্রশাসনিক ব্যর্থতায় মানুষের কতটা মোহভঙ্গ হয়েছে, তার প্রতিফলন দেখা গেল চার রাজ্যের বিধানসভার ফলে।
রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ-দিল্লি ও ছত্তীসগঢ়ের ফল বিশ্লেষণ করলে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই রাজ্যগুলিতে মনমোহন সিংহের সরকার তথা কংগ্রেস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে এক চূড়ান্ত অনাস্থার আবহ তৈরি হয়েছিল। সে অনাস্থা প্রশাসনিক ব্যর্থতার জন্য, সে অনাস্থা নীতিপঙ্গুত্বের জন্য। আর সে কারণেই রাহুল গাঁধী এই সব রাজ্যে প্রচারে নেমে নতুন ভারত গড়ার স্বপ্ন দেখালেও তাকে সফল ভাবে বিক্রি করতে পারেননি।
যা পেরেছেন নরেন্দ্র মোদী। যা পেরেছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
প্রথম ইউপিএ সরকারের সময় থেকেই সনিয়া গাঁধী কংগ্রেসকে গরিব মানুষের দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাঁর যুক্তি ছিল, গাঁধী-নেহরুর আমলে কংগ্রেস ছিল গরিবের দল। পরবর্তী কালে দলে অভিজাততন্ত্রের দাপট বাড়ায় কংগ্রেস আমজনতার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সে কারণে কেন্দ্রে সরকার গঠনের পরে নানা ধরনের সামাজিক প্রকল্প গ্রহণ করে আমজনতাকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসকে এক ধরনের ‘ইনক্লুসিভিস্ট অ্যাপ্রোচ’-এ নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। এর প্রেক্ষাপটে দলের তাত্ত্বিক মস্তিষ্ক ছিলেন অমর্ত্য সেন ও জঁ দ্রেজ। সেই নীতি রূপায়ণের মঞ্চ ছিল জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ (এনএসি)। আর রাহুল গাঁধী ছিলেন সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’। |
|
জয়ের উল্লাস। দিল্লির অশোক রোডে বিজেপির সদর
দফতরের সামনে সমর্থকেরা। ছবি: রমাকান্ত কুশওয়াহা। |
চার রাজ্যের নির্বাচনী ফল কিন্তু সনিয়া গাঁধীর সেই জনকল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গিরও বিপর্যয়। নরসিংহ রাওয়ের জমানায়, ১৯৯১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ যে সংস্কারের জয়ধ্বজা উড়িয়েছিলেন, ইউপিএ গঠনের পর মনমোহন-চিদম্বরম-মন্টেক জুটি কিন্তু চাইলেও সেই অভিমুখে হাঁটতে পারেননি। উল্টে কিছুটা অনিচ্ছার সঙ্গেই একশো দিনের কাজ, খাদ্য সুরক্ষা-সহ একের পর এক প্রকল্প ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন সনিয়া গাঁধীর চাপে। তার সঙ্গে কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিতে এটা-ওটা-সেটা নানা ধরনের দাতব্য প্রকল্প তো ছিলই! কংগ্রেসের অন্দরের খবর, মনমোহন-চিদম্বরম-মন্টেকদের মতো রাহুলও এ ভাবে একের পর এক প্রকল্প ঘোষণার বিরোধী ছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে তিনিও এ সব মেনে নিয়েছিলেন। এ সবের সঙ্গে শরিকদের চাপে চালিয়ে যেতে হয়েছে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকিও। পরপর সামাজিক প্রকল্পের কথা ঘোষণা করতে গিয়ে সরকার বারবার সার্বিক বৃদ্ধির উপরে জোর দিলেও সম্পদ তৈরির বিষয়টিকে সে ভাবে গুরুত্বই দেয়নি। ফলে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এখানেই শেষ নয়। অর্থনীতির প্রকৃত উন্নয়নের বদলে সরকার সামাজিক প্রকল্পে জোর দেওয়ায় রাজকোষ ফাঁকা হয়েছে দ্রুতগতিতে। পাল্লা দিয়ে কমেছে আর্থিক বৃদ্ধির হার। কমেছে কর্মসংস্থানের সুযোগ, বেড়েছে বেকারি। এ সবের সঙ্গে যোগ হয়েছে মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কা, যা জনতার ক্ষোভকে বেঁধে দিয়েছে উঁচু তারে।
এখানেও তো শেষ নয়। সরকারের প্রশাসনিক ব্যর্থতা আর নীতিপঙ্গুত্বের হাত ধরে সামাজিক প্রকল্পগুলির বিস্তর ফাঁকফোকর প্রকাশ্যে এসেছে। তাতে ক্ষোভ বেড়েছে আমজনতার। ফলে যে সামাজিক প্রকল্প, ভর্তুকি-রাজের উপর নির্ভর করে এই সে দিনও কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব ভোট-বৈতরণী পার হওয়ার কথা ভেবেছিলেন, সে সবই ডুবেছে জনতার রোষে!
কংগ্রেস নেতৃত্ব এটাও ভেবেছিলেন যে নরেন্দ্র মোদী-বিরোধী হাওয়া তুলে ভোট প্রচারের ময়দানে নামলে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ হবে, তাতে সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষ, উদারনৈতিক হিন্দু সমাজ, বাম এবং নাগরিক সমাজ তাঁদের পক্ষেই যাবে। কিন্তু চার রাজ্যের ফলে সে সব প্রচারের প্রতিফলন কই? বরং প্রশ্ন উঠেছে, মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার পরেও যদি মানুষ কংগ্রেসের দিকে না তাকায়, তা হলে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, মোদীর নেতৃত্ব মোটেই পরিত্যাজ্য নয়?
আসলে মোদী নিজে কিন্তু প্রচারে কোথাও হিন্দুত্ব, রামমন্দির এ সব কথা বলেনইনি। গুজরাতের প্রশাসনিক সাফল্যের মডেল তুলে ধরে তিনি গোটা দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটমোচনের স্বপ্ন বিক্রি করতে চেয়েছেন। কংগ্রেসের নীতিপঙ্গুত্বকে আক্রমণ করে শক্ত হাতে হাল ধরার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ফল প্রকাশের পরে এটা স্পষ্ট যে, ফেরিওয়ালা হিসেবে মোদীর গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি। বিজেপি নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদের ব্যাখ্যা, “অমর্ত্য সেন ও জগদীশ ভগবতী বিতর্কে বোধহয় ভগবতীর অর্থনৈতিক লাইনকে গ্রহণ করার সময় এসেছে। মানুষ বুঝতে পারছেন, সস্তা জনপ্রিয়তার স্লোগান দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। চাই মোদীর মতো এক জন জবরদস্ত প্রশাসক, যিনি দেশকে মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি, নীতিপঙ্গুত্ব ও দুর্নীতির হাত থেকে মুক্ত করতে পারবেন।”
তবে ঘটনা হল, মোদীকে নিয়ে বিজেপির অন্দরেই প্রশ্ন আছে। যদিও সঙ্ঘ পরিবার চায়, মোদীকেই সামনে রেখে এগোতে। কারণ তাঁর একটা বড় প্রভাব এই ভোটে পড়েছে। অনেকে আবার বলছেন, মোদীর প্রভাব থাকলেও ম্যাজিক নেই। যদি ম্যাজিক থাকত, তা হলে আরও ভাল ফল হত। ১৯৭৭-এ জয়প্রকাশ নারায়ণ বা ১৯৮৯-এ ভি পি সিংহকে সামনে রেখে যেমনটা হয়েছিল, এ বার মোদীকে সামনে রেখে তেমন ঝড় ওঠেনি।
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, মোদী কি সর্বভারতীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পেরেছেন? নীতীশ-মমতা-মুলায়মের মতো আঞ্চলিক দলের নেতারা মোদীকে সর্বভারতীয় অবয়ব হিসেবে মানতে নারাজ। যা শুনে মোদী-সমর্থকদের বক্তব্য, ভারতের মতো একটা জটিল বহুত্ববাদী দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন অনেক বদলে গিয়েছে। আঞ্চলিক দলে একজন নেতার উপরেই সব কিছু নির্ভর করে। মায়াবতী, মুলায়ম, মমতার দল এই নিয়মেই পড়ে। কিন্তু কংগ্রেস ও বিজেপি, দু’টোই সর্বভারতীয় দল। সেখানে এ ভাবে কিছু হওয়াটা কঠিন। অন্তত এই সময়ের প্রেক্ষাপটে।
অতীতে কংগ্রেসের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, জওহরলাল-ইন্দিরার আমলেও বিধান রায়, কামরাজ, বিজু পট্টনায়েকের মতো আঞ্চলিক চরিত্ররা ছিলেন। যাঁরা নিজের নিজের রাজ্যে তুমুল জনপ্রিয়। ফলে জাতীয় নায়কদের পাশাপাশি এই আঞ্চলিক মসিহাদেরও নিয়ে একটা প্যাকেজ ছিল কংগ্রেসের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক নেতাদের এই ভূমিকাটাই গৌণ হয়ে গিয়েছে কংগ্রেসে। যা কিছু হয়েছে সবই হাইকম্যান্ডের নির্দেশে।
অন্য দিকে জনসঙ্ঘ এবং পরে বিজেপির অন্দরে কিন্তু এই আনুপাতিক ভারসাম্যটা ছিল এবং এখনও অনেকটাই রয়েছে। ফলে শিবরাজ সিংহ চৌহান, বসুন্ধরা রাজেরা দলের হার-জিতে বড় ভূমিকা নিয়ে থাকেন। পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদীর ভূমিকাকেও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করে চার রাজ্যে ভোটে যাওয়া। মোদীর নাম প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার পরে দলের অন্দরেই অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা গিয়েছে। মোদীর নির্বাচন চূড়ান্ত হওয়ার আগে যে কর্মীরা হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, পরে তাঁরাই হইহই করে প্রচারে নেমেছেন। মোদীর প্রভাবে অনেকটাই কমেছে নেতাদের অন্তর্বিরোধ। সবচেয়ে বড় কথা, নিচুতলার কর্মীরা মোদীকে সামনে রেখে একত্র হয়েছেন। কংগ্রেসের নীতিপঙ্গুত্বে বিরক্ত শিল্পপতিরাও সে পথেই হেঁটেছেন। এ সবই নরেন্দ্র মোদীর বড় অবদান। আর এর দৌলতেই চার রাজ্যে জয়ের পথ অনেক সুগম হয়েছে।
তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। এর পরে বিজেপি কি পারবে লোকসভা ভোটের পরে সরকার গড়তে?
একটাই উত্তর, অন্তত এখনই তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ, এই পর্যায়ে যে চার রাজ্যের ভোটে বিজেপি কংগ্রেসকে কার্যত উড়িয়ে দিয়েছে, সেখানে তাদের একটা নিজস্ব ভোটব্যাঙ্ক-প্রভাব আছেই। কংগ্রেসের ব্যর্থতায় তা আরও বেড়েছে। তা ছাড়া দিল্লির ফলে এটাও স্পষ্ট, কংগ্রেসের ব্যর্থতার সুফল একা বিজেপি পায়নি। কেজরিওয়ালের দলও লাভ ঘরে তুলেছে। বিজেপির সামনে সেটাও একটা বড় প্রশ্ন।
তা ছাড়া, দক্ষিণ এবং পূর্ব ভারতের অবস্থাটা বিজেপির পক্ষে এখনও ততটা অনুকূল নয়। সেখানে আঞ্চলিক দলের হাত ধরতেই হবে তাদের। ফলে ফের এনডিএ গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে দলকে। বিজেপির শীর্ষ নেতাদের একাংশ কিন্তু বরাবরই প্রথমে এনডিএ গঠনের উপরে জোর দিতে চেয়েছেন। কিন্তু এ বারে সঙ্ঘ-পরিবারের কৌশল হল, আগে হিন্দুত্বকে সামনে রেখে বিজেপি কতটা আসন বাড়াতে পারে, দেখা যাক। তার পরে এনডিএ গঠন নিয়ে প্রশ্নের সমাধান করা যাবে। |
|
|
|
|
|