|
|
|
|
কেজরিওয়ালই ম্যান অব দ্য ম্যাচ |
নিজস্ব প্রতিবেদন
৮ ডিসেম্বর |
হারটা প্রত্যাশিতই ছিল। কিন্তু শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে চার রাজ্যেই অপ্রত্যাশিত ব্যবধানে হারল কংগ্রেস!
আজ সকাল আটটায় প্রথম ইভিএম খোলা থেকেই কংগ্রেসের হারের পালা শুরু। তার পর বেলা যত গড়িয়েছে, ততই খারাপ থেকে আরও খারাপ খবর এসেছে একের পর এক রাজ্য থেকে। সকাল দশটার আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, দিল্লির পনেরো বছরের দুর্গ ধূলিসাৎ হওয়ার পথে। রাজস্থানে ইদানীং কালের মধ্যে সব চেয়ে খারাপ ফলের দিকে এগোচ্ছে দল। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিংহ চৌহানের বিরুদ্ধে কোনও লড়াই-ই গড়ে তোলা যাচ্ছে না। দুপুর পর্যন্ত আশা জাগিয়ে রেখেছিল একমাত্র ছত্তীসগঢ়। কিন্তু দিনের শেষে হতাশ হয়ে ফিরতে হয়েছে সে রাজ্য থেকেও।
কংগ্রেসের এই ফলকে কটাক্ষ করে বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদী টুইট করেছেন, ‘বিজেপি একটা রাজ্যে যত আসন পেয়েছে, কংগ্রেস চারটে রাজ্য মিলে তত পায়নি!’ আর আগামী বছরের লোকসভা ভোটে যাঁকে মোদীর প্রতিপক্ষ বলে মনে করা হচ্ছে, সেই রাহুল গাঁধীকে বিঁধে অরুণ জেটলির মন্তব্য, “এই ভোটের পরে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, নরেন্দ্র মোদী আর রাহুল গাঁধীর কোনও তুলনাই হয় না।”
তবে কংগ্রেস যে শুধু মোদীকে সামনে রেখে চাঙ্গা হয়ে ওঠা বিজেপি-র কাছেই পর্যুদস্ত হল এমন নয়। দিল্লিতে তাদের মাটি ধরিয়ে ছেড়েছে একেবারে নবাগত আম আদমি পার্টি। কংগ্রেসের ভোট ব্যাঙ্ক কার্যত তাদের দখলে। ২০০৮-এর তুলনায় এ বার ৩৫টি আসন কম পেয়েছে কংগ্রেস। যার ২৮টি গিয়েছে আম আদমি পার্টির দখলে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতই প্রায় ২৬ হাজার ভোটে হেরে গিয়েছেন রাজনীতির ময়দানে অজ্ঞাতকুলশীল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কাছে। একেবারে পিছন থেকে উঠে এসে বাজিমাত করা রাজনীতির শিক্ষানবিশ কেজরিওয়ালই আজকের ম্যান অব দ্য ম্যাচ। এবং তাঁর এই চমকপ্রদ ফল দেখে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীকে হারের দায় মাথায় নিয়ে বলতে হয়েছে, “আমরা আম আদমি পার্টির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছি। তারা যে ভাবে আনকোরা লোককে প্রার্থী করেছে, ভবিষ্যতে আমরাও তা-ই করতে চাই।” |
|
বিস্বাদ জন্মদিন। আজ সোমবার ৬৮-তে পা দিচ্ছেন সনিয়া গাঁধী। কিন্তু রবিবার চার রাজ্যের
বিধানসভা ভোটের ফল ম্লান করে দিল দিনটা। রবিবার দিল্লিতে তোলা পিটিআই-এর ছবি। |
দিল্লিতে যদি অরবিন্দ ইতিহাস গড়ে থাকেন, (বস্তুত, আজ সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আম আদমি পার্টির প্রধান তাঁর দলের জয়কে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যাই দিয়েছেন) তা হলে মধ্যপ্রদেশে পরপর তিন বার সরকার গড়ার কৃতিত্ব অর্জন করলেন শিবরাজ সিংহ চৌহান। গত বারের তুলনায় ২২টি আসন বাড়িয়ে। অথচ গত কাল রাত পর্যন্ত দলীয় সূত্রে পাওয়া বিশ্লেষণ দেখে মধ্যপ্রদেশ নিয়ে কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তাতেই ছিলেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। কিন্তু রবিবার দুপুরের আগেই স্পষ্ট হয়ে যায়, হাসতে-হাসতে দুই তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌছে যাচ্ছে দল। বেলা দু’টোর আগেই মধ্যপ্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া হার স্বীকার করে বলে দিয়েছেন, “খুবই হতাশাজনক ফল। খতিয়ে দেখতে হবে, কেন এমন হল।”
পরে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীও চার রাজ্যের নিরিখেই বলেছেন, “মানুষ অসন্তুষ্ট না হলে এই ফল হত না। আমরা ভীষণ ভীষণ হতাশ। কেন এই হার হল তা গভীর ভাবে সমীক্ষার প্রয়োজন।” একই সুর রাহুলেরও। তাঁর কথায়, “এই ফলাফল আমাদের একটা বার্তা দিয়েছে। কংগ্রেস এ বার নিজেকে বদলাবে।”
বদলটা কোথায় দরকার, সেটা অবশ্য কংগ্রেস মহলের অন্দরে কান পাতলেই বোঝা যাচ্ছে। দলের একটা বড় অংশই বলছে, গত পাঁচ বছর ধরে মধ্যপ্রদেশে নেতারা খেয়োখেয়ি করেছেন। দিগ্বিজয় সিংহ, না জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া কার রাজ চলবে, তাই নিয়ে চলেছে টানাপোড়েন। ভোটের পনেরো দিন আগে হাইকম্যান্ডের নির্দেশে ওপরে ওপরে ঐক্য হয়েছে। কিন্তু তত দিনে ভিতরে ভিতরে ক্ষয়ে গিয়েছে দলের ভিত।
শুধু মধ্যপ্রদেশে নয়, গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের ক্ষত চার রাজ্যের জন্যই সত্যি বলে দাবি করছেন কংগ্রেসের ওই অংশ। তাঁদের বক্তব্য, এই কারণে রাজস্থানও যে ধরে রাখা যাবে না, সেটাও জানাই ছিল। অশোক গহলৌতের পাঁচ বছরের শাসনের পরে কংগ্রেসের আসন ৯৫ থেকে কমে হয়েছে ২১। আর বিজেপি এক লাফে ৮৪টি আসন বাড়িয়ে পৌঁছে গিয়েছে ১৬২-তে। কংগ্রেস নেতা জনার্দন দ্বিবেদীর কথায়, “২০০৮-এর ভোটের পর থেকেই শুনে আসছি পরের বার রাজস্থানে আমরা ৫০টার বেশি আসন পাব না। তা হলে এই পাঁচ বছরে সেই বিপর্যয় সামাল দেওয়ার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হল না কেন!”
শিবরাত্রির সলতের মতো কংগ্রেসের আশা জেগে ছিল ছত্তীসগঢ়ে। দিনভর সেখানে যেন ঢেঁ-কুচকুচ খেলা! কখনও কংগ্রেস দু’টো আসনে এগিয়ে যাচ্ছে তো খানিক পরেই তাদের পিছনে ফেলে দিচ্ছে বিজেপি। দিনের শেষে কংগ্রেসের হতাশার ঘড়া পূর্ণ করে শেষ হাসিটা রমন সিংহই হেসেছেন। গত বারের তুলনায় একটা আসন কমে বিজেপি-র আসন সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৯। প্রশস্ত হয়েছে ৪-০ ফলের পথ। |
|
জয়ের খবর পাওয়ার পরে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ছবি: পিটিআই। |
দিল্লিতে বিজেপি নিরঙ্কুশ নয় বটে, কিন্তু একক সংখ্যগরিষ্ঠ হিসেবে সরকার গড়ার ডাক পাওয়ার দাবিদার। (রাতে বিজেপি নেতারা অবশ্য বলেছেন, তাঁরা বিরোধী আসনে বসতে চান। কিন্তু এটা আদতে কৌশল। ভিতরে ভিতরে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চলছে বলেই দলীয় সূত্রে খবর) অঙ্কের হিসেবে কংগ্রেস আম আদমি পার্টির দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দিলে বিজেপি-কে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু মূলত কেন্দ্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে উঠে আসা কেজরিওয়ালের পক্ষে সেই হাত ধরা কঠিন। তাই এ দিন সন্ধ্যায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, কারও সঙ্গে জোট করবে না আম আদমি পার্টি। কংগ্রেস-বিজেপিকে সতর্ক করে তাঁর মন্তব্য, “দুর্নীতি যে মানুষ আর সহ্য করবে না, সেটা দুই দলের নেতাদেরই বোঝা দরকার। তা না হলে ক্রমশ অন্যত্রও তারা মুছে যাবে।”
প্রশ্ন হল, দুর্নীতি আর পঙ্গু প্রশাসনের জেরেই কি বাকি তিন রাজ্যেও ধরাশায়ী কংগ্রেস? কিন্তু দলের নেতারাই বলছেন, নিছক আঞ্চলিক সাফল্য-ব্যর্থতার নিরিখে এই ফলাফলকে দেখা উচিত হবে না। তাঁদের মতে, সর্বভারতীয় ভাবে দল এবং সরকারকে যে ভাবে চালাতে চেয়েছেন সনিয়া-রাহুল, সেটাই অনেক বেশি করে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। জনমোহিনী অর্থনীতির যে মডেল খাড়া করেছেন সনিয়া, তাতে শুধু ভারতের কাহিনিই দুর্বল হয়নি, দুর্বল হয়ে পড়েছে কংগ্রেসও।
দেশের যে ক’টি রাজ্য গোড়াতেই সনিয়ার প্রিয় খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্প চালু করেছে, দিল্লি তাদের অন্যতম। গ্রাহকদের অ্যাকাউন্টে সরাসরি ভর্তুকি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাও সবার আগে চালু হয়েছে এই রাজ্যে। খাদ্যশস্য থেকে মাগনা ওষুধ রাজস্থানে সামাজিক সুরক্ষা খাতে জলের মতো টাকা খরচ করেছে অশোক গহলৌতের সরকার। তার পরেও এই বিপর্যয়। যার জেরে সনিয়াকেও বলতে হয়েছে, “রাজস্থানে এত জনকল্যাণ কর্মসূচি সত্ত্বেও কেন হার হল ভেবে দেখতে হবে।” কংগ্রেসের একাংশের ব্যাখ্যা, এই ফলের মধ্যে দিয়ে জনগণ বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা খয়রাতি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে রাজি নন। বাঁচতে চান সম্মান নিয়ে। কংগ্রেস মহলের এই মনোভাব উস্কে শরিক নেতা ওমর আবদুল্লা যে টুইট করেছেন, তার নির্যাস: শেষ মুহূর্তে জনমোহিনী প্রকল্পের ঘুষ দিয়ে ভোটে জেতা যায় না। |
বিস্তারিত দেখতে ক্লিক করুন... |
|
|
কিন্তু ঘটনা হল, এই প্রশ্নে কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় তুললে বিজেপিকে ছাড় দেওয়া যায় কী ভাবে! দান-খয়রাতিতে বিজেপি-শাসিত দুই রাজ্য মোটেই কম যায়নি। যেমন মধ্যপ্রদেশে ১ টাকা কেজি দরে গম বিলিয়েছেন শিবরাজ। তা হলে তাদের ভাল ফলের কারণ কী? সেটা কি নরেন্দ্র মোদীর প্রভাব? অরুণ জেটলির দাবি, মোদী ম্যাজিক অবশ্যই কাজ করেছে। তাঁর কথায়, “গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে মোদীর নাম ঘোষণা করার পর থেকেই দলীয় কর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনার জোয়ার এসেছে। সেই উদ্দীপনাই এই জয় আনল।”
সেই যুক্তি আবার মানছেন না অনেকেই। চার রাজ্যের ফলাফলের সার্বিক ছবিটা এখনও পুরোপুরি স্পষ্ট না-হলেও তাঁদের মতে জনগণের মানসিকতা যতটা না বিজেপি-পন্থী, তার থেকে অনেক বেশি কংগ্রেস-বিরোধী বলেই এখনও পর্যন্ত মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভোট কার বাক্সে গিয়েছে, সেটা মূলত নির্ভর করেছে দু’টি বিষয়ের উপরে। এক, স্থানীয় নেতৃত্বের শক্তি। এবং দুই, বিকল্পের উপস্থিতি। কংগ্রেসের ক্ষেত্রে প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় নেতৃত্ব দুর্বল। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে বিজেপি এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। বিকল্পের অভাবও সুবিধা করে দিয়েছে তাদের।
কিন্তু দিল্লিতে আম আদমি পার্টি সামনে থাকায় বিজেপি ততটা ভাল ফল করতে পারেনি। এই বিশ্লেষণের সূত্র ধরে অনেকেই মনে করছেন, আগামী লোকসভা ভোটে হিন্দি বলয়ে বিজেপি-র যাত্রা মোটেই মসৃণ হবে না।
বিজেপি নেতারা অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, প্রথমত আগামী কয়েক মাসে কংগ্রেসের অবস্থা আরও খারাপ হবে। আর দ্বিতীয়ত, অন্যত্র দল বিস্তারের চেষ্টা করব বললেও দিল্লির বাইরে আম আদমি পার্টি কোনও প্রভাবই ফেলতে পারবে না। আর এই অঙ্ক থেকেই নরেন্দ্র মোদীর দিল্লিযাত্রা ক্রমশ নিষ্কণ্টক হচ্ছে বলেই তাঁদের দাবি।
মোদীর যাত্রাভঙ্গ করতে এ দিন থেকেই অবশ্য উঠেপড়ে লাগার অঙ্গীকার করেছে কংগ্রেস। রাহুল বলেছেন, “এ বার আমরা যুবসমাজকে এমন ভাবে কাজে লাগাব যে আপনারা চিন্তাই করতে পারবেন না।” অন্য দিকে, এত দিন চুপ করে থাকার পর সনিয়া আজ জানিয়ে দিয়েছেন, এ বার কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রীর পদপ্রার্থীর নাম ঘোষণা করে দেবেন তিনি। সেমিফাইনালে হেরে কংগ্রেস নেতারা বলছেন, আর ছায়াযুদ্ধ নয়, ফাইনালে বাঁচতে গেলে মোদীর সঙ্গে লড়তে হবে সামনাসামনি। |
মানুষ অসন্তুষ্ট না হলে
এই
ফল হত না। আমরা
ভীষণ ভীষণ হতাশ।
সনিয়া গাঁধী |
কেন এই বিপর্যয় শুধু
বুদ্ধি নয়, আমরা
হৃদয় দিয়ে বুঝেছি।
রাহুল গাঁধী |
বিজেপি একটা রাজ্যে যত আসন
পেয়েছে, কংগ্রেস চার রাজ্য
মিলে তত আসন পায়নি ।
নরেন্দ্র মোদী |
|
বেওকুফ আমরা, তাই
মানুষের মন বুঝতে পারিনি।
শীলা দীক্ষিত |
আম আদমি পার্টির নয়,
আম আদমির-ই জয় এটা।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল |
|
|
পুরনো খবর: ভোট কাকে দেবেন, ভেবে নাজেহাল দিল্লির বামেরা |
|
|
|
|
|