ভেঙ্কটেশ্বর কলেজ। নিউ দিল্লি। শহরের সেরা গ্র্যাজুয়েশন কলেজগুলোর একটি।
এর বিশাল চৌহদ্দির মধ্যে যে ক্রিকেট ক্লাব, তার নাম গোটা দেশ জানে।
সনেট ক্রিকেট ক্লাব। তিরিশ বছর ধরে ‘দিল্লি ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন’-এর সঙ্গে যুক্ত। প্রতিভাবান ক্রিকেটার তুলে আনতে ‘সনেট’-এর জুড়ি নেই। যাঁদের অনেকেই বাইশ গজে দেশের হয়ে মাঠে নেমেছেন।
একাডেমির কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে যে মানুষটি, তিনি তারক সিন্হা। তাঁর হাতে তৈরি ব্রিগ্রেড থেকে অনেকেই এই মুহূর্তে দুনিয়ার বড় বড় মঞ্চে ঝকঝকে পারফর্ম করছে।
|
তারক সিন্হা |
শিখর ধবন। গত কয়েক বছরে তারক সিন্হার অন্যতম সেরা ‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’। বার কয়েক গোঁফে পাক দিয়ে তুড়ি মেরে বোলারদের তুলোধোনা করতে পারেন। সারা পৃথিবী জানে এটাই তাঁর ট্রেড মার্ক।
“শুনুন, এই হল আজকের প্রজন্ম।” বলছিলেন তারক সিন্হা, “বিরাট কোহলিকে দেখুন, গোটা শরীরটা প্রায় ট্যাটুতে ঢাকা। ঠিক যেমন শিখরের গোঁফ আর পনিটেল। এটাই ওর সিগনেচার। ওদের ধাতটাই আলাদা। এরা চায়, ওদের অ্যাটিচিউডটা শরীর থেকে ফুটে বেরোক। আস্তিনের ওপর ওরা ওদের ‘প্রাণ’টা নিয়ে ঘোরে। সেখান থেকে ঠিকরে বেরোয় ওদের আত্মবিশ্বাস।”
তারক সিন্হা ফিরে গেলেন ফেলে আসা দিনে।
“একটা বাচ্চা ছেলে এল অ্যাকাডেমিতে। বছর বারো বয়েস। ওই বয়েসে প্রত্যেকেই তো চায় দেশের হয়ে খেলতে, সে’ও তাই,” বলতে থাকেন তারক সিন্হা, “কিন্তু শুধু ইচ্ছেটা থাকলেই তো ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট খেলা যায় না। একটা ‘স্পার্ক’-এর দরকার। আমি ওর মধ্যে সেই স্পার্কটা খুঁজে পেতে চাইছিলাম।”
অ্যাকাডেমির ‘অ্যানুয়াল সামার টুর্নামেন্ট’ থেকেই শুরু হয়ে গেল সেই ‘স্পার্ক’-এর চোখ ধাঁধানো চমক।
টুর্নামেন্টটায় প্রত্যেক বছর সারা শহরের সমস্ত দলগুলোর সঙ্গে অ্যাকাডেমির সব ক্রিকেটার খেলতে পারে। এ রকমই একটা আন্ডার-টুয়েলভ টুর্নামেন্টে তারক সিন্হা নতুন একজন খুদে প্রতিভাকে খুঁজে পান।
“তখনই দেখলাম, ওর মধ্যে একটা আগুনটা রয়েছে। একদম শুরু থেকে বোলারদের ধুনে দেওয়ার খুনে মেজাজ। অতটুকু বয়েসে শুধুমাত্র স্ট্রোক নেওয়াতেই মাস্টার নয়, বল সিলেকশন, জাজমেন্টে অসাধারণ। টুর্নামেন্টের ফাইনালে সেঞ্চুরি করল। তার পর থেকে ওকে আর উপেক্ষা করতে পারিনি।” বললেন সিন্হা।
এর পরের ধাপটা ছিল ওই কিশোর ছেলেটির দক্ষতায় ঘষেমেজে শান দেওয়া। একটা আকর হাতে নিয়ে তাতে যত্ন করে পালিশ দেওয়ার মতো। ধীরে ধীরে আন্ডার সিক্সটিন আর আন্ডার নাইন্টিন দিল্লি ক্রিকেট টিমে ধবনের ‘প্রেজেন্স’টা হয়ে উঠল একজন ধারালো পারফর্মারের।
ডাক এল ২০০৩-০৪ আন্ডার নাইন্টিন ওয়ার্ল্ড কাপে। তাতে শিখরের ব্যাটিং গড় গিয়ে দাঁড়াল ৮৪.১৬-য়। তিনটে সেঞ্চুরি। মোট রান ৫০৫। ‘প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট’ দিতে আর অন্য কারও নাম ভাবতে হয়নি।
“আজকাল আন্ডার নাইন্টিন ওয়ার্ল্ড কাপের সাফল্যকে জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়ার সিওর-শট টিকিট হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ঘটনা হল, এটা অনেকের ক্ষেত্রেই সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে প্রতিযোগিতার বাজারে। যেটা হয়েছিল শিখরের ক্ষেত্রে,” থামলেন সিন্হা। তার পর বললেন, “অনেক খেলোয়াড়ই আছেন, যারা দ্রুত এই তালিকায় পড়ে গেছে। যুবরাজ সিংহ আর মহম্মদ কায়েফ...। কিংবা বিরাট কোহলি। ধবনও এ রকমই কিছু একটা আশা করেছিল।” বলছিলেন তাঁর ছোটবেলার কোচ।
আশা তো ছিল, কিন্তু তখনকার অবস্থাটা যে বেশ অন্য রকম।
বীরেন্দ্র সহবাগ, আকাশ চোপড়া, গৌতম গম্ভীর ওপেনার হিসেবে রাজ করছেন। শুধুমাত্র ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রচুর খেটেখুটে ওঁরা এই জায়গায় পৌঁছেছেন। তুলনায় ধবন তখন একজন ইয়ংস্টার মাত্র। ফলে জাতীয় দলে ঢুকতে হলে ধবনকে অপেক্ষা করতেই হবে। শুধু আন্ডার নাইনটিন ওয়ার্ল্ড কাপের সাটিফিকেটে হবে না।
“দীর্ঘ অপেক্ষার সময়টা ধবনের পক্ষে ছিল প্রচণ্ড হতাশার। প্রত্যেকটা সময় কোনও না কোনও দল সিলেকশন হচ্ছে, তার কোথাও ওর জায়গা হচ্ছে না। অসম্ভব বেপরোয়া হয়ে উঠছিল ও। বার বার আসত আর বলত, ‘দেখুন, আবার সিলেক্টেড হলাম না। বাদই রয়ে গেলাম।’ প্রচণ্ড ভেঙে পড়ছিল।” বলছিলেন তারক সিন্হা। |
কিন্তু তার জন্য আজও কোনও ভাবে কোনও সিলেক্টরকে দায়ী করতে চান না তারক সিন্হা। বললেন, “সহবাগরা তখন অটোমেটিক চয়েস। ধবনের জায়গা হবে কোথায়? কিন্তু এই অবস্থায় পড়ে শিখরের অন্য একটা লাভ হল। সিনিয়ররা যেহেতু দেশের হয়ে খেলে বেড়াচ্ছে, ওর পক্ষে দিল্লির হয়ে মাঠে নামাটা একেবারে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। আমি এটাই চাইছিলাম, অলটারনেটিভ কোনও একটা প্ল্যাটফর্মে ও একটা ‘আউটলেট’ পাক। ওর ক্ষেত্রে সেটা হয়ে দাঁড়াল জোনাল ক্রিকেট। ব্যাটে ঝুড়ি ঝুড়ি রান আসতে লাগল। আর সব চেয়ে যেটা লক্ষ করার, ওর মন ভেঙেছিল ঠিকই, কিন্তু খেলায় তার প্রভাব পড়তে দেয়নি। সব সময় পজিটিভ থেকেছে। নিজের খেলা খেলেছে। ফলে রেজাল্ট পেয়েছে।”
জাতীয় দলের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ৮১টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলা হয়ে গেল ধবনের। রান ৫৬৭৯। এত ভাল পারফর্মেন্সের পরও কিন্তু ডাক নেই। “আসলে দলে জায়গা মাত্র ১১টা। পুরো টিম ধরলে বড়জোর ১৫টা। এদিকে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে ট্যালেন্টের তো অভাব নেই,” বলছিলেন সিন্হা। এর ওপর ধবন একজন স্পেশালিস্ট ওপেনার। এই স্লটে কেউ একজন হারিয়ে না গেলে শিখরের পক্ষে ঢোকা প্রায় অসম্ভব।
শেষমেশ সুযোগ একটা এল। ২০১০। একদিনের আন্তর্জাতিক। বিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু সে ম্যাচে শিখর ডাহা ফেল। ফলে আবার অপেক্ষা। পরের ডাক পেতে পেরিয়ে গেল আরও তিনটে বছর।
এর মধ্যে দিল্লি ডেয়ারডেভিলস ছেড়ে মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে চলে গেলেন ধবন। সেখান থেকে সানরাইজ হায়দরাবাদ (পুরনো নাম ডেকান চার্জার্স)। “এই জার্নিটা বা বলুন এই এক্সপোজারটা ছিল শিখরের কাছে খুব ইন্টারেস্টিং। নিজের জায়গাটা ঠিক ঠিক করে বুঝে নেওয়ার জন্য এটা খুব কাজে দেয়। এক-একটা জায়গায় এক-এক রকম ডিমান্ড, তার সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হল। অ্যাডজাস্ট করতে হল। তার থেকে একটা ম্যাচুওরিটি এল ওর,” বলছিলেন সিন্হা।
একাডেমিতে প্রচুর প্রাক্তন ক্রিকেটার আসতেন। শিখর তাঁদের প্রত্যেকের সঙ্গে কথা বলতেন। “আশিস নেহরা ছিল ওর খুব ভাল বন্ধু। আকাশ চোপড়া তো বলতে গেলে মেন্টরের কাজ করত। যুবরাজ আর সহবাগ যখনই অ্যাকাডেমির নেটে আসত, শিখর চলে যেত ওদের কাছেও। ও তখন ‘পাখির চোখ’ ছাড়া কিছুই দেখে না। কী ভাবে এত কম্পিটিশনের মধ্যেও এগিয়ে যাওয়া যায়? কী ভাবে জাতীয় দল ফেরা যায়? একজন ইয়ং ক্রিকেটার হিসেবে ওই সময়টা ছিল ওর কাছে একটা বড় লেসন্। ধবন বুঝেছিল, দীর্ঘ অপেক্ষার মানেটা ঠিক কী। কতটা ধৈর্য লাগে সেই দমবন্ধ করা সময়টা পেরোতে।” বললেন সিন্হা।
সহবাগ ফর্ম হারালেন। দল থেকেও ছিটকে গেলেন। সুযোগ এল। এ বার কিন্তু মোহালির ম্যাচে হতাশ করলেন না শিখর। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের তুবড়ির মতো ওড়াল ধবনের ব্যাট।
“অতগুলো বছরের কঠোর পরিশ্রম। দিনের পর দিন অপেক্ষা, ওকে মানসিক ভাবেও কঠোর করে দিয়েছিল। আন্তর্জাতিক ম্যাচে দ্বিতীয় পর্যায়ের শিখর তাই একেবারে আলাদা একজন মানুষ। ক্রিকেট জীবনের গোড়ার পর্বের মতো সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে আদর্শ মানা খুদে প্রতিভা নয়। দিল্লির সিনিয়র দলে সহবাগ, গম্ভীরদের সম্ভ্রমের ছায়ায় থাকা ছেলেটিও নয়। তত দিনে ও জেনে গেছে ওরাও তার মতো লড়াই করছে। ওর বিশ্বাস জন্মেছে, সে একজন ভারতীয় ওপেনিং ব্যাটসম্যান, যে পৃথিবীর যে কোনও শক্তির মুখোমুখি হতে চায়। নিজের জায়গার জন্য লড়াই করতে চায়। আর সেই জায়গাটা ও একা নিজের হাতে তৈরি করেছে।” বললেন তারক সিন্হা।
সদ্য আইসিসি ওয়ান ডে ব্যাটসম্যানদের র্যাঙ্কিং-এ দশের মধ্যে ঢুকে পড়েছে শিখর। জীবনে প্রথম বার। সনেট ক্রিকেট ক্লাবে খেলতে আসা বারো বছরের ছোট্ট ছেলেটির দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন এখন ঘোরতর বাস্তব। ওর বিধ্বংসী ব্যাট দিনে দিনে আরও ত্রাস হয়ে উঠছে বিপক্ষের।
তবু তারক সিন্হা আজও কিছুতেই ভুলতে পারেন না ‘সনেট’-এর সেই ছোট্ট ছেলেটিকে। |