শনিবারের নিবন্ধ
আশিতে আসিলাম
নেক স্টেশন, জংশন ও সিগন্যাল পেরিয়ে জীবনের রেলগাড়ি অবশেষে আশি বছরে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করল।
বংশধারা অনুযায়ী মস্ত ব্যাপার, পিতৃদেব তাঁর ষাট বছর দেখেননি, তাঁর পিতৃদেবও নিতান্ত স্বল্পায়ু, যার ফলে আমার অনাথ পিতা অপরের বাড়িতে মানুষ হয়েছেন। নিজের প্রতিভা ও প্রচেষ্টায় তিনি এনট্রান্স থেকে বিএসসি পর্যন্ত সব পরীক্ষায় পদক, স্কলারশিপ ইত্যাদি পেয়েছেন।
আমি অর্থাভাবে জীবনের প্রথম পর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নেহপ্রশ্রয় থেকে বঞ্চিত হয়েছি, যদিও বহু বছর পরে বঙ্গবাসী রাত-কলেজের দৌলতে ব্যাকডোরে একটা বিএ ডিগ্রি সংগ্রহ করেছি।
ইস্কুল থেকেই একটা গ্রাম্য রসিকতা কানে আসত ৮০-তে ৮০ও না! আরও শুনতাম, জন্মাবার পরে পৃথিবীতে দাগ রাখবার জন্য অশীতিপর হবার কোনও প্রয়োজন নেই। আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ চল্লিশও দেখেননি। বয়সের সঙ্গে সাফল্যের কোনও কার্যকারণ সম্বন্ধ নেই। পরবর্তী সময়ে নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বংশদোষ এড়িয়ে গড়গড় করে পঞ্চাশ ও ষাটের মাইলস্টোন পেরিয়ে গেলাম। যদিও আরও দ্বাদশ বছর পরে মজার ব্যাপার ঘটল।
সেবারের ৭ ডিসেম্বর সুরসিক জননেতা অনিল বিশ্বাস আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে ফোন করে বললেন, “একটা বছর একটু মুখ বুজে ধৈর্য সহকারে চলতে হবে, লোকে বাহাত্তুরে বলে একটু হেয় করবার চেষ্টা চালাবে, তবে মাত্র একটা বছর, তার পর সব নর্মাল হয়ে যাবে!”
বাহাত্তুরে ব্যাপারটা মানিয়ে গুছিয়ে নিয়েছি, একটা বছর ভুলেও কোনও বেফাঁস মন্তব্য করিনি। আর স্মরণ করেছি পরলোকগত কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের কথা ব্লাড প্রেশার ও ডায়াবিটিসই কেবল নয়, অকারণে বকবক করা এবং কমবয়সিদের অনর্গল উপদেশ দেওয়াটাই বার্ধক্যের সব থেকে বিপজ্জনক লক্ষণ ও ব্যাধি।
বিমল মিত্র বলতেন, আমাদের দেশে যৌবনকালটাই একমাত্র কাল, তার গলাতেই যত জয়মাল্য, তার কারণ এদেশে বার্ধক্যটা দুর্লভ, পথেঘাটে বৃদ্ধদের দেখতে পাবেন না। পশ্চিমে ব্যাপারটা অন্য রকম, তাঁদের কর্মক্ষমতা কমলেও, সঞ্চিত অর্থের ক্ষমতা সুদূরপ্রসারী, তার উপর বৃদ্ধরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে নানা কনসেশন আদায় করছেন বাস কনসেশন, ট্রেন কনসেশন, প্লেন কনসেশন, ট্যাক্স কনসেশন, এমনকী ধোপার কাছ থেকেও কনসেশন। আমাদের দেশে বৃদ্ধসংখ্যা যতই বাড়বে এই সব সুযোগসুবিধার দাবিও তত বাড়বে এবং এই করতে করতে যথাসময়ে এই ধরণী বয়োবৃদ্ধভারে নত হয়ে পড়বে।
কর্মক্ষমতা নেই কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ক্ষমতা আছে এমন মানুষের ভারে সামাজিক ভারসাম্যেও চাপ পড়বে। যে সব চিন্তাবিদ এবং বিদ্বজ্জনের উপর দেশের পরিচালনার দায়িত্ব রয়েছে তাঁরা বার্ধক্যবিরোধী যুক্তি বিচার করেও সিনিয়রদের আরও সুখসুবিধে দিতে চান। তাঁদের কাছে আশি বছর বয়সটা একটা মস্ত মাইল পোস্ট। তাই ‘আশিতে আসিয়াই’ আমার পরামর্শ, সকলকেই ম্যাকসিমাম সুখের জন্য এই বয়সে আসতেই হবে।
ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে হ্যাংলামো এবং অকারণ ঔৎসুক্য পরিণত এই বয়সে মানায় না। বরং সব ব্যাপারে রিয়ারভিউ মিরর মাধ্যমে অতীতের দিকে দৃষ্টিপাত করাটাই শোভনীয়।
পথের পাঁচালীর দেশ বনগ্রামে ১৯৩৩-এর শেষ মাসে আমার জন্ম। তখন দেশ পরাধীন, কিন্তু বাংলাসাহিত্যের মস্ত সময়। তখন কারা কারা সাহিত্যজননীর সেবায় ব্যস্ত তা ভাবলে রোমাঞ্চিত হতে হয়। ভাবতে ভাল লাগে, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মধ্যগগনে। কাজি নজরুল তখনও সৃষ্টিশীল। কথাসাহিত্যের প্রণম্য শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন ভারতবিজয়ে ব্যস্ত। জন্মভূমি বনগ্রামে ইছামতীর অপর পারে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বিশ্ববিজয়ে বেরিয়েছেন।
বাংলা কথাসাহিত্যের গোল্ডেন এজ তখনও শুরু না হলেও স্বর্ণযুগের নাগরিকরা ইতিমধ্যেই সাহিত্যের আসরে তাঁদের উপস্থিতি ঘোষণা করেছেন। তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাকি দু’জন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের বিজয়রথের দায়িত্ব গ্রহণ করতে চলেছেন। আর এক বন্দ্যোপাধ্যায় শরদিন্দুর আবির্ভাব ঘোষিত হয়েছে।
আরও কত অবিস্মরণীয় শিল্পীর উপস্থিতিতে বঙ্গ মহোৎসবের সূচনা হতে চলেছে অবনীন্দ্রনাথ, বিমল মিত্র, বনফুল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, শিব্রাম চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, পরশুরাম। বাংলা প্রবন্ধসাধক যাঁরা ইতিমধ্যেই জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁরাও আমাদের স্মরণীয় দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার, নীহাররঞ্জন রায় এবং অবশ্যই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
শরৎচন্দ্রের দেহান্তের সময় আমার বয়স পাঁচ। তখন যে হাওড়া শহর কিছু দিন আগে তিনি ছেড়ে গিয়েছেন সেখানেই আমার আইনব্যবসায়ী পিতৃদেব ভাগ্যসন্ধানে সপরিবার উপস্থিত। আর ‘রবি যেদিন অস্তাচলে’ সেদিন আমি হাওড়া জেলা ইস্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। জনপ্রবাহ সেদিন জোড়াসাঁকোর দিকে, কিন্তু একলা পথ খুঁজে কলকাতা পৌঁছানো আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সারা জীবনের একটা আফশোস, আমি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছি বলা চলল না অল্পের জন্য।
তখন মহা যুদ্ধ ও মিলিটারির চাপে বেশ খারাপ সময়, অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে গেল মিলিটারি ও আধা মিলিটারিকে স্থান দিতে গিয়ে। ফলে জেলা ইস্কুল ছেড়ে কাছাকাছি বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হতে হল। রবীন্দ্রনাথ হাতছাড়া হলেও স্বামী বিবেকানন্দকে পাওয়া গেল হাতের মুঠোয়, আমাদের মাস্টারমশায়দের অনেকেই অবিবাহিত এবং বিবেকানন্দপাগল। এক সময় কোহিনূর থিয়েটারের নাট্যকার এবং পরবর্তী সময়ে উকিল পিতৃদেব তখনও গিরিশ ঘোষ ও মাইকেল মধুসূদনকে বুকে আঁকড়ে বসে আছেন, সাহিত্যকর্মে দ্বিতীয় পক্ষের জ্যেষ্ঠপুত্রকে তিনি মোটেই উৎসাহ দিতেন না। ক্লাস এইটে পড়বার সময় স্কুলের ম্যাগাজিনে একটা লেখা বেরোতে বাবা বিরক্তি প্রকাশ করলেন, আজেবাজে চেষ্টায় সময় নষ্ট না করে, অঙ্কে মন দাও।
শেষ যৌবনে লেখক। ছবি: তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর অবশ্য যথেষ্ট কারণ ছিল, নিতান্ত যৌবনকালে বিডন স্ট্রিটের কোহিনূর থিয়েটারে নাট্যকার হিসেবে খ্যাতিমান হয়েও কয়েকটা বছর অপচয় করে বাবা আদালতের প্র্যাকটিসে পিছিয়ে পড়েছিলেন, বাবার ইচ্ছে নয় তাঁর কোনও ছেলের এই রোগ ধরুক।
তখন ইস্কুলে হেডমাস্টার সুধাংশুশেখর ভট্টাচার্য মশায়ের কিন্তু অন্য সুর, তাঁর আহ্বানে ও বিশেষ উৎসাহে লুকিয়ে লুকিয়ে একটা রম্য রচনা লিখে ফেলতে হল। চৌধুরীবাগানে তখন আমার সাহিত্যযাত্রায় একমাত্র সহযাত্রী পাশের বাড়ির চিরকুমার কালামাজু কোম্পানির স্টেনোগ্রাফার, প্রবল মাতৃ-অনুরাগী বাদলচন্দ্র বসু। গোপনে তিনি আমার ‘কলমপেশা জাত’ প্রবন্ধের উদ্বোধনী প্যারাগ্রাফটি লিখেছিলেন। মোটেই পছন্দ হয়নি আমার, চেয়েছিলাম রবিঠাকুরের একটা কোটেশন দিয়ে শুরু করব, কিন্তু বাদলকাকু রবি ঠাকুর পড়েননি, নিত্য-গঙ্গাস্নানে প্রবল বিশ্বাসী বাদলকাকু প্রবন্ধের শুরু করলেন, এক দিন গঙ্গার ঘাটে তেল মাখতে মাখতে গিলান্ডার কোম্পানির বড়বাবু বলে উঠলেন, কলমপেষা এই জাতটার কিছু হবে না।
আশ্চর্য ব্যাপার, স্কুলের সাহিত্য সভায় সেই লেখা সকলের খুব পছন্দ হল, হেডমাস্টারমশায় বললেন, যা নিজের চোখে দেখেছ, তাই সাহস করে কারও তোয়াক্কা না করে লিখে যাবে, ঝকঝকে হওয়ার চেয়ে অরিজিন্যাল হওয়া অনেক ভাল। আমাদের হাওড়ায় গঙ্গা আছে, রামকৃষ্ণপুর ঘাট আছে, সরষের তেল গায়ে মাখার রেওয়াজ আছে, আমরা কী করতে পারি?
এই উপদেশ পরবর্তী জীবনে আমার খুব কাজে লেগে গিয়েছিল। তাই প্রথম উপন্যাসে ব্রিটিশ ব্যারিস্টার, গম্ভীর মুখ জজসাহেবের সঙ্গে হাইকোর্ট ভবনের বার লাইব্রেরি ক্লাবের সামনের বেঞ্চিতে-বসা ব্যারিস্টারের বাবু ও উকিলের মুহুরিদের সমান স্থান দিতে পেরেছি। হেডমাস্টারমশাই বলতেন, ফেরিওয়ালার কৌটোতে সাদা মুড়ি যখন মশলা মুড়িতে পরিণত হয় তখন তার দাম অনেক বেড়ে যায়। বিবেকানন্দ পড়ো, বিবেকানন্দ পড়ো, সব বুঝতে পারবে, নিজস্ব একটা পথ সাহিত্যের দুর্গম অরণ্যের মধ্যেও খুঁজে পাবে।
সহস্রাধিক শব্দ লিখে ফেললাম, অথচ মা অভয়ারানীর কথা এখনও উল্লেখও করলাম না তা কী করে হয়? আশি বছর তো দূরের কথা, মা না থাকলে এই পৃথিবী থেকে কবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতাম!
স্বামী বিবেকানন্দ বার বার চিরউন্নতশির হওয়ার প্রেশক্রিপশন দিচ্ছেন, অথচ চিরনতশির হয়েই জীবনটা কাটাতে হল কেন? তার কারণ বোধহয় আমার মায়ের বাবা ক্ষীরোদ ব্যানার্জি। ডালহৌসির বিলিতি সদাগরি অফিসে মোটামুটি ভাল কাজই করতেন, কিন্তু ছোকরা এক সাহেব অপমানজনক আচরণ করায় ইংরেজপুঙ্গবকে তৎক্ষণাৎ একটি চড় মেরে দাদু কর্মক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে গেলেন। অনেকেই উন্নতশিরের প্রশংসা করলেন, কিন্তু মায়ের পিতৃদেব ও তাঁর কন্যা অথৈ জলে পড়ে গেলেন।
আমার জননী অসামান্যা সুন্দরী, কিন্তু অর্থাভাবে দোজবরে পাত্রের হাতে পড়লেন, যাঁর প্রথম পক্ষের জ্যেষ্ঠা কন্যা বিবাহিতা। বিবাহকালে নিজের ভাগ্যের সঙ্গে নিজের গৌরী নামটিও হারাতে হল। কারণ প্রথম পক্ষের জ্যেষ্ঠপুত্রের নামও গৌরী। নতুন নাম হল অভয়া কে দিয়েছিলেন জানি না, নামদাতা তাঁর মানসচক্ষে তাঁর নতুন ভূমিকাটি যেন চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিলেন।
নকফুল গ্রামের ক্ষীরোদ ব্যানার্জি বনগ্রামে অভয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্রসন্তানকে দেখতে এলেন। আঁতুড় ঘরে তাঁর আদরের কন্যা অঝোরে কাঁদছেন। সবাই বলছে, অমন সোনা রঙের মাতৃগর্ভে কালো রঙের ছেলে! পিতৃদেব নবজাতকের রং ফর্সা করার জন্য জার্মান পিংক পাউডার এনেছিলেন, তিনি মেয়েকে বলে গেলেন, “দুঃখ করিস না অবি, তোর ছেলে আশু মুখুজ্জে হবে।”
পিতৃবাক্যকে খুব সিরিয়াস ভাবে নিয়েছিলেন মা। আশুতোষ মুখুজ্জে বিদ্যার জাহাজ হয়েছিলেন, স্যর হয়েছিলেন, জজ হয়েছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন। অতি অল্প বয়েসে আমি বুঝেছিলাম, শত দুঃখের মধ্যেও তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
একটা খবর যথাসময়ে কানে এল, আশুতোষ গণিতশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত। যথা সময়ে আমিও ইস্কুলের অর্ধ-বাৎসরিক পরীক্ষায় অঙ্কের পেপার জমা দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম, মায়ের সনির্বন্ধ অনুরোধে বাবা হিসেব করতে বসলেন এবং বললেন, আমি আশি কিংবা ছিয়াশি পাব। ফলাফল যখন প্রকাশিত হল, তখন দেখা গেল মাত্র বারো পেয়েছি। আমার আঙ্কিক মেধার মূল্যায়নে কে এমন অঘটন ঘটাল তা আজও আমার কাছে রহস্যাবৃত। তবে সত্য কথাটি হল, প্রতিটি বছর অঙ্কে আমার লজ্জাজনক ভূমিকা মাকে খুব কষ্ট দিত।
ইস্কুলে আমাদের হিমাংশুবাবু স্যার বলতেন, ছেলেরা দু’রকমের ময়ূরে এবং কুকুরে। এর অর্থ ময়ূরেগুলো প্রথম দিকে দেখতে খারাপ, কিন্তু ক্রমশ পেখম মেলে সবার হৃদয় হরণ করে। আর কুকুরগুলো প্রথমে দৃষ্টিনন্দন, কিন্তু বয়েস বাড়লে খারাপ হয়ে যায়। আমি কোন শ্রেণিতে তা জানতে চাওয়ায় বিপদ ঘটল, স্যার নির্দ্বিধায় বললেন, তুমি তৃতীয় গ্রুপে, বাঁদুরে! ছোটবয়েসে যা, বুড়োবয়েসেও তা, সব সময় বাঁদুরে!
তবু হেডমাস্টারমশায় সুধাংশুশেখর আমার ওপর বিশেষ ভরসা রাখতেন। বলতেন, ভেবেচিন্তে মাঝে মাঝে এমন সব কথা লিখে যাবে যে লোকের মাথা ঘুরে যায়!
কিন্তু এসব কিছুই ঘটল না, দেশ স্বাধীন হওয়ার মাস পাঁচেক আগে কারফিউ আক্রান্ত এক রাতে পিতৃদেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন আমার মা ও তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের আট ছেলেমেয়েকে অকূলপাথারে ভাসিয়ে দিয়ে। মা কী করে ভাড়াবাড়িতে থেকে গোটা দুয়েক জীবন বিমার ওপর নির্ভর করে আমাদের উদ্ধার করলেন তা আজও আমি বুঝতে পারি না। ষোলো বছর বয়েসে একদিন মা আমাকে জানিয়ে দিলেন, দু’তিন মাসের মধ্যে কিছু রোজগার করতে না পারলে অনশন ছাড়া আর কিছুই নেই।
কলকাতা শহরে কাউকে চিনি না, তার ওপর নাবালক সারাদিন ডালহৌসির সদাগরি অফিস পাড়ায় ঘুরে বেড়াই, অথচ বেশি ঘুরে বেড়ালে খিদে পায়। সেই সময় ধর্মতলায় কার্জন পার্কে কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতির জলসত্রের বৃদ্ধটি সন্তুষ্ট হলে জলের সঙ্গে মাঝে মাঝে বাতাসা দিতেন। আর একজন অপরিচিত প্রয়োজনীয় উপদেশ দিলেন, মুড়ি অথবা বাতাসার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে জল খেলে খিদে চাপা পড়ে যায়। ‘জয় বিশ্বনাথের জয়’ উপদেশটা খুব কাজে লেগেছিল।
এই সময়ে যে সব অমূল্য অভিজ্ঞতা অপরিচিত জনদের কাছ থেকে লাভ করেছিলাম পরবর্তী কালের সাহিত্যজীবনে তা খুব কাজে লেগে গিয়েছিল। ওই যে মহাপুরুষগণ উপদেশ দিয়ে গিয়েছেন, চরৈবেতি, চরৈবেতি, এর বিশেষ মূল্য আছে। আচমকা আলাপ থেকে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, সামান্য কিছু রোজগারেরও সুযোগ হয়ে যায়। মানুষের এই পৃথিবী যে এখনও ভালবাসাশূন্য হয়নি বার বার তার প্রমাণ মিলেও যায়। তবু মনে কোনও দ্বিধা এলে পথে এবং পার্কে সামনেই রয়েছেন বড় বড় লোকেদের স্ট্যাচু দারভাঙার মহারাজা, চার্টার্ড ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা উইলসন সাহেব, স্যার হরিরাম গোয়েন্কা এবং আরও অনেকে। ভক্তিভরে যোগাযোগ করলে এঁরা বিত্তহীন কর্মপ্রার্থী কমবয়েসিদের সঙ্গে তাঁদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতেন। এ সব খুব কাজে লেগে গিয়েছিল।
এত দিন পরে সেই সব কথার পুনরাবৃত্তির লোভ হয়, কিন্তু অনেকে সাবধান করে দেন, যুগের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে, এখন কেউ বিশ্বাস করে না কেউ আপন সাধনায় ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে, যা কিছু হবার তা হবে রাজনীতির পরিবর্তনে।
আমার ওসব ভাববার সময় নেই, আমাকে রোজগার করতে হবে। তবে কি বিলাস বলে কিছু নেই? অবশ্যই আছে। এসপ্ল্যানেড ম্যানসনের তৎকালীন ইউ এস আই লাইব্রেরিতে বিনা পয়সায় বই ও ঠান্ডা জল পাওয়া যেত। একদিন খুব তৃষ্ণার্ত অবস্থায় ওখানে গিয়ে ইংরেজি বই ওল্টাতে ওল্টাতে একখানা প্রবন্ধ লিখে ফেললাম, তারপর ডাকখরচ বাঁচাবার জন্য উত্তরমুখো হাঁটতে হাঁটতে চিৎপুর ফলপট্টিতে বর্মণ স্ট্রিটের সাবেকি আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসের পোস্ট বক্সে লেখাটা ফেলে এলাম। কী আশ্চর্য! সেই লেখা রবিবাসরীয়তে প্রকাশিত হয়েছিল এবং মানি অর্ডার মারফত দশ টাকা উপার্জনও করেছিলাম। এসব তো ছ’দশকের বেশি সময় আগেকার কথা, কিন্তু নিজের কলমের জোরে এত টাকা উপার্জন সম্ভব তা ভেবে রাতে ঘুম আসত না!
লেখক হওয়ার স্বপ্ন ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ছুড়ে বিবেকানন্দ স্কুলের হেডমাস্টার দয়াপরবশ হয়ে নাবালক ছাত্রকে একটা মাস্টারি দিলেন এবং অবশেষে কলকাতা হাইকোর্টের শেষ ইংরেজি ব্যারিস্টার নোয়েল ফ্রেডরিক বারওয়েল সায়েবের শেষ বাবু হওয়ার দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করা গেল।
বারওয়েল-সান্নিধ্য আমার জীবনের সব চেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। আমি এক আশ্চর্য মানুষের স্নেহচ্ছায়ায় আশ্চর্য এক পৃথিবীর সন্ধান পেলাম যা ছাড়া আমার এই জীবন অপূর্ণ থেকে যেত। এক সময় সায়েবের স্বাস্থ্য আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠল। আমার তো এক দিনও চাকরি ছাড়া চলবে না তা বুঝে সায়েবই আমাকে রয়াল এক্সচেঞ্জের বেঙ্গল চেম্বার অব কমার্সে একটা চাকরি জোগাড় করে দিলেন এই প্রত্যাশায় যে প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি তাঁর কাজকর্ম করে দিয়ে আসব। এই সুখও কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হল না। ১৯৫৩ সালের অগস্ট মাসে মাদ্রাজে একটা কেস করতে গিয়ে সেখানেই আদালতে সায়েব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং অবশেষে কলকাতায় সেই ভয়ঙ্কর টেলিগ্রাম এল, ওখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
এমন মানুষের স্মৃতি কি চির দিন অম্লান থাকবে? এক দিন হয়তো নিজেরই বিশ্বাস হবে না, আমার মতো এক জন নিতান্ত সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই দয়াময় বিদেশি অসাধারণত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। তার বুকের প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবার জন্য সস্নেহে বলেছিলেন, কখনও ভুলো না তুমি একজন ‘এক্সেপশনাল পার্সন’। সায়েবের স্মৃতিরক্ষার আর কোনও পথ খুঁজে না পেয়ে চেষ্টা করেছিলাম তাঁর নামাঙ্কিত একটা রাস্তার ব্যবস্থা করতে পারিনি, স্বাধীন ভারতে কেউই বিদেশি সাহেবকে সম্মানিত করতে উৎসাহী নন।
অবশেষে মনে পড়ে গেল, পৈতৃকসূত্রে আমার রক্তে লেখার অধিকার রয়েছে এবং লেখার জন্য কোনও খরচ নেই। তাই একদিন চুপিচুপি বসে পড়লাম বিদেশিসান্নিধ্যে আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ করতে। বলা বাহুল্য, আনন্দবাজারে প্রকাশিত রবিবাসরীয়র লেখাটাও যথেষ্ট সাহস জুগিয়েছিল।
তার পর আর পিছন দিকে তাকাইনি। খেয়ালি ভাগ্যবিধাতা যাত্রার শুরুতেই আমার কপালে সৌভাগ্যের জয়টিকা এঁকে দিয়েছেন। প্রথমে অনেকের সন্দেহ ছিল ‘ওয়ান বুক লেখক’ একটা লিখেই শেষ হয়ে যাবে।তখন আমার একমাত্র প্রার্থনা, আমি খ্যাতি, সম্মান, স্বীকৃতি কিছু চাই না আমাকে ওই ওয়ান বুক অথরের গ্লানি থেকে মুক্তি দাও। প্রমাণ দিতে সময় লেগেছিল ছ’বছর। তারপর একদিন সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় ‘চৌরঙ্গী’ প্রকাশিত হতে লাগল, গর্ভধারিণী জননী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, মা সিদ্ধেশ্বরী মুখ তুলে চেয়েছেন, এই ভাবে নিজের খেয়ালে আর রাতের পর রাত জেগে থাকিস না। মায়ের কথায় আশ্বস্ত হয়ে আমি বহু বছর পরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে শুরু করলাম।
তার পরেও তো সাহিত্যের প্রাঙ্গণে অনেক বছর কেটে গেল। বিমল মিত্র বলতেন, বড্ড বেয়াড়া এই লাইন, একবার ভাল লিখলেই মুক্তি নেই, ক্রমশ আরও ভাল এবং আরও ভাল না লিখলে দুর্নাম অবশ্যম্ভাবী। পাঠক যত পায়, তত চায়। আরও যা বলতেন তা অবিস্মরণীয়। লেখকের জীবন হোললাইফ ইন্সিওরেন্সের মতন, মরার আগে কত পাওনাগণ্ডা তার হিসেবই হবে না। যা পাবার তা সব সময় মরার পরে। জীবিতকালে খোরাকি ছাড়া কিছুই মেলে না লেখকের, লেখাই এক মাত্র আজব জীবিকা যা মরার পরও স্রষ্টাকে বাঁচিয়ে তোলে। তাকিয়ে দেখুন, পুরো বাংলা সাহিত্যকে মৃতরাই দোর্দণ্ডপ্রতাপে শাসন করে যাচ্ছেন সেই বিশ শতকের শুরু থেকে।
কম বয়েসে শুরু করে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকাটা যে কতটা কষ্টের এবং কত যন্ত্রণার তা যে কোনও দীর্ঘজীবী লেখককে চুপি চুপি জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন। তবু সব বাধাবিপত্তি সুনাম দুর্নাম প্রত্যাশা হতাশা পেরিয়ে কলম হাতে সশরীরে আশিতে হাজির হওয়া আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা, সুখের যেন শেষ নেই।
যদি প্রশ্ন করেন, সব চেয়ে বড় সুখ কোনটা? তা’হলে বলতে দ্বিধা নেই পাঠক-পাঠিকার ভালবাসা। এই পরম সৌভাগ্য কী ভাবে আসে এবং বহু ক্ষেত্রে কেন চলে যায় তা কোনও লেখকই আজ পর্যন্ত খুঁজে বার করতে পারেননি। তবে খেয়ালি এই পাঠক-দেবতার চরণে প্রণাম জানাতে জানাতে যে আশিতে পৌঁছনো গেল এর থেকে সৌভাগ্যের আর কী হতে পারে? এই জনমের শেষ নমস্কারটি চেনা অচেনা, আগত এবং অনাগত পাঠকের জন্যই রেখে যেতে চাই।
বিবেকানন্দ ইস্কুলে পড়বার সময় শুনেছিলাম, সতত প্রতিকূল অবস্থার বিরুদ্ধে আত্মপ্রকাশ ও বিকাশের নামই জীবন। হাইকোর্টের আদালতি কর্মক্ষেত্রে বিদেশি ব্যারিস্টারের মুখে শুনেছিলাম, জীবনের সব আনন্দ ভাগ করে নিলে দ্বিগুণ হয়, আর দুঃখে ভাগ বসালে অর্ধেক হয়ে যায়। আর মা চরম দুঃখের মধ্যে চৌধুরীবাগানের বিদ্যুৎবিহীন বাড়িতে বসে হ্যারিকেনের আলোয় বই পড়তে পড়তে বলতেন, প্রত্যেক মানুষের বুকের মধ্যে একটা প্রদীপ বসানো আছে। সেটা জ্বলে উঠলে খুব আলো হয়। আর আমার বৈমাত্রেয় ছোটদা গাইতেন, ‘জয় হবে হবে জয়, মানবের তরে মাটির পৃথিবী, দানবের তরে জয়’। অপরের দেওয়া দানে ভিক্ষাপাত্র পূর্ণ করে আশি বছরের ৭ ডিসেম্বরের মুখোমুখি হতে আশ্চর্য এক অনুভূতিতে মন ভরে উঠছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.