জামিন, কিন্তু জীবিকা নিয়ে চিন্তায় জ্যোতির্ময়
হাকরণে কীটনাশক ছড়িয়ে খরচ-খরচা বাদ দিয়ে হাতে থাকত তিনশো টাকা। তার জন্যই ছ’রাত থানার লক-আপে কাটাতে হল!
শুক্রবার জামিন পাওয়ার পরে জ্যোতির্ময় নন্দীর মুখে এই আক্ষেপ তো ছিলই। পাশাপাশি নিজের ও পরিজনদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাও গোপন করেননি হুগলির শ্রীরামপুরের বাসিন্দা ওই প্রৌঢ়। এ দিন ব্যাঙ্কশাল আদালত একশো টাকার ব্যক্তিগত জামিনে জ্যোতির্ময়কে মুক্তি দিয়েছেন। সরকারি কৌঁসুলিও জামিনের আর্জির বিরোধিতা করেননি। মুক্ত জ্যোতির্ময় সন্ধ্যায় শ্রীরামপুরের রামকৃষ্ণপল্লিতে নিজের বাড়িতে বসে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “গায়ে এমন তকমা পড়ে গেল, কাজ পেতেই সমস্যা হবে। কী করে সংসার চলবে কে জানে?” ধরা গলায় তাঁর স্বগতোক্তি, “অপরাধীরাই তো অ্যারেস্ট হয়। তা-ই আমিও এখন মার্কা মারা অপরাধী হয়ে গেলাম!”
গত ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় মহাকরণে স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন রেজিস্ট্রার অফ পাবলিকেশনের অফিসঘরে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যায়। স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, এর পিছনে নাশকতার ছক রয়েছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্র-সচিব চক্রান্তের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে বলেন। পুলিশ চার জনকে আটকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জ্যোতির্ময়বাবুকে গ্রেফতার করা হয়। জ্যোতির্ময়বাবু দীর্ঘ দিন যাবৎ রেজিস্ট্রার অফ পাবলিকেশন বিভাগে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করে আসছেন। এবং তিনি নিজেই জানিয়েছেন, আগেও তিনি কীটনাশকের সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে ওখানে স্প্রে করেছেন।
গ্রেফতার হওয়া ইস্তক জ্যোতির্ময়বাবুর ঠিকানা ছিল হেয়ার স্ট্রিট থানার লক-আপ। এ দিন আদালতে জামিন পাওয়ার পরে তিনি দাবি করেন, মহাকরণের সেই হোম পাবলিকেশন অফিসের রেজিস্ট্রার বিস্ময় রায় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মী সঞ্জয় কর্মকারের কথা মতোই তিনি সে দিন কাজ করেছিলেন। “ওঁরা আমাকে বললেন, পোকা মারার ওষুধ মেশানো যতটুকু তেল স্প্রে-মেশিনে পড়ে রয়েছে, ঘরের মেঝেয় ঢেলে দিতে। তা-ই করেছিলাম।” বলেন জ্যোতির্ময়। কিন্তু ওঁকে ঘরের মেঝেয় তেল ঢালতে বলা হল কেন?
শ্রীরামপুরে নিজের বাড়িতে জ্যোতির্ময় নন্দী। ছবি: প্রকাশ পাল।
জ্যোতির্ময়ের দাবি, ১৫ ফুট বাই ৩০ ফুটের ঘরটায় কংক্রিটের মেঝেতেও উইপোকা ঘোরাফেরা করছিল। তা দেখেই বিস্ময়বাবুরা ওঁকে বলেছিলেন মেঝেয় বাকি তেলটুকু ঢেলে দিতে, যাতে উই মরে যায়।
জ্যোতির্ময়বাবু এ দিন জানিয়েছেন, রেজিস্ট্রার অফ হোম পাবলিকেশনের অফিসে ফি মাসের শেষ শুক্রবার করে কীটনাশক ছড়িয়ে আসতেন তিনি। এ ব্যাপারে ‘ওয়ার্ক অর্ডার’-ও তাঁর কাছে ছিল বলে প্রৌঢ়ের দাবি। জ্যোতির্ময়বাবু জানান, গণেশচন্দ্র অ্যাভিনিউয়ের দোকান থেকে কীটনাশক কিনে দু’লিটার কেরোসিন তেলে মিশিয়ে তিনি তা অফিসের বইয়ের তাকে, চেয়ার-টেবিলে স্প্রে করতেন। কেরোসিন আর কীটনাশক কিনতে খরচ পড়ত দু’শো টাকা। সঙ্গে নিজের তিনশো টাকা মজুরি জুড়ে মোট পাঁচশো টাকার বিল জমা দিতেন দফতরে।
এবং ঘটনার দিনও বিলের টাকা তিনি হাতে-হাতে পেয়ে গিয়েছিলেন। “আগে বহু বার আমি একই কাজ করেছি। আগেও এ ভাবেই পোকা মারার বিষে কেরোসিন মিশিয়ে মেঝেয় ঢেলে দিয়েছি। তখন তো কোনও অসুবিধা হয়নি! এ বার হল কেন?” প্রশ্ন তুলছেন জ্যোতির্ময়। তিনি জানাচ্ছেন, ২০০৭ ইস্তক তিনি স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন বিভাগটিতে কীটনাশক ছড়িয়ে আসছেন। প্রথমে অফিসটা ছিল ভবানী ভবনে, পরে মহাকরণে চলে আসে। “স্প্রে হয়ে গেলে গ্রুপ-ডি কর্মীরা ঘর বন্ধ করে চলে যেতেন। শনি-রবিবার রাইটার্স বন্ধ থাকে। তাই টানা দু’দিন ওষুধের প্রভাব থাকত।” বলছেন তিনি।
২৯ নভেম্বর কী ভাবে তিনি মহাকরণে ঢুকলেন?
জ্যোতির্ময় জানান, বিকেল তিনটে নাগাদ তিনি মহাকরণের গেটে পৌঁছে বিস্ময়বাবুকে ফোন করেন। তাঁকে জি ব্লকের পাঁচতলার অফিসে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিস্ময়বাবু মহাকরণের গেটে পাঠান সঞ্জয় কর্মকারকে। সঞ্জয়ই তাঁকে পাঁচতলায় নিয়ে যান। জ্যোতির্ময়ের দাবি, সে দিন ঢোকার সময়ে মহাকরণের গেটে কেউ তাঁকে বাধা দেয়নি। কাজ সেরে ঘণ্টা দেড়েক বাদে তিনি নির্বিঘ্নে বেরিয়েও যান।
তখন স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি, ওই কাজের খেসারত তাঁকে এ ভাবে দিতে হবে। এ জন্য জ্যোতির্ময় অবশ্য কাউকে দায়ী করছেন না। সবটাই ‘কপালের ফের’ হিসেবে দেখছেন। ঠিক যেমন ‘কপালের ফেরেই’ তাঁর এই পেশায় আসা। কী রকম?
জ্যোতির্ময়বাবু বলেন, “ফৌজে চাকরির পরীক্ষায় পাশ করেছিলাম। মা-বাবা বাদ সাধলেন। ওঁদের কথা ফেলতে পারিনি। অন্য চাকরিও জোটেনি। অগত্যা অফিসে-অফিসে পোকা মারার কাজ।” কিন্তু হাজত-ফেরত লোককে আর কেউ তেল ছড়ানোর জন্য ডাকবে কিনা, তা নিয়ে এই মুহূর্তে তিনি প্রবল আশঙ্কায়। “এটাও হাত থেকে চলে গেলে তো পরিবার নিয়ে না-খেয়ে থাকতে হবে!” অবসাদ-হতাশায় রুদ্ধ শোনায় প্রৌঢ়ের গলা।
তবে কিছু মানুষ যে ওঁর পাশে আছে, এ দিন সন্ধে থেকে তার ইঙ্গিত পাচ্ছে রামকৃষ্ণপল্লির নন্দীবাড়ি। পাড়া-পড়শি তো বটেই, আছেন দূরের অচেনা লোকও। যেমন দুর্গাপুরের অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ অরুণকুমার ভৌমিক এ দিন নিজেই যোগাযোগ করেছেন, প্রতি মাসে আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জ্যোতির্ময়ের স্ত্রী অপর্ণাকে। প্রতিবেশীরাও সমব্যথী। এলাকার যুবক গুরুপ্রসাদ সোমের আশ্বাস, “আমরা ওঁদের সঙ্গে আছি। প্রয়োজনে সব সাহায্য করব। জ্যোতির্ময়বাবুর মতো সৎ, নির্লোভ আর পরিশ্রমী মানুষ এই সময়ে বিরল।”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.