জ্যোতির্ময়কে আনল না কেন, কোর্টে কান্না মায়ের
প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে এজলাসের ভিতরের বেঞ্চে ঠায় বসে রয়েছেন তিয়াত্তর বছরের এক বৃদ্ধা। মাঝে মাঝেই বলছেন, “এখনও তো ওকে আনল না পুলিশ!”
বৃ্দ্ধার পাশে বসে বছর পঁচিশের এক যুবক। তিনি সান্ত্বনা দিচ্ছেন, “থানার অফিসারেরা যখন বলেছেন, তখন ঠিকই আনা হবে।”
এজলাসের দরজার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই পরনের সাদা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নিচ্ছিলেন চিত্রা নন্দী। মহাকরণে কেরোসিন তেল মেশানো কীটনাশক ছড়িয়ে গ্রেফতার হওয়া জ্যোতির্ময় নন্দীর মা। নাতজামাই তুষার আঢ্যকে সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই শ্রীরামপুর থেকে চলে এসেছেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। বসে রয়েছেন ছেলের প্রতীক্ষায়।
দুপুর সাড়ে বারোটায় একটি ফোন এল। মোবাইলে মেয়ে সুমিতা দাস জানালেন, হেয়ার স্ট্রিট থানার পুলিশ তাঁকে দেখা করতে দিচ্ছে না জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে। এ দিন তাঁকে আদালতে তোলা হবে কি না, সে ব্যাপারেও পুলিশের কেউই মুখ খুলছেন না। উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল চিত্রাদেবীর। নাতজামাইকে বললেন, “তবে যে থানার অফিসারেরা বললেন, এ দিন ওকে আদালতে এনে জামিন পাইয়ে দেবেন!” কী করা উচিত বুঝতে না পেরে আরও কিছুক্ষণ আদালতেই বসে থাকলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে জানলেন, জ্যোতির্ময়কে এ দিন আদালতে আনা হচ্ছে না।
আর সামলাতে পারলেন না নিজেকে। আদালত কক্ষের বাইরে এসে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৃদ্ধা। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, “ছেলেকে ফিরে পাব বলে আদালতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যাব।”
কেন জ্যোতির্ময়কে আদালতে তোলা হল না এ দিন?

ছেলের প্রতীক্ষায়। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে জ্যোতির্ময়ের মা চিত্রা নন্দী। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
সব পুলিশকর্তাই কার্যত মুখে কুলুপ এঁটেছেন। এক জন শুধু বললেন, “থানার অফিসারেরা চিত্রাদেবীকে কী বলেছেন, জানি না। তবে জ্যোতির্ময়কে এ দিন আদালতে তোলার কোনও সিদ্ধান্ত উপরমহলে হয়নি।” তদন্তকারীরাও এ নিয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে থানার সামনে দাঁড়িয়ে জ্যোতির্ময়ের দিদি সুমিতা এ দিনও দাবি করেন, “ওঁরা ভাইয়ের জামাকাপড় পর্যন্ত নিয়ে আসতে বলেছিলেন। অসুস্থ মা ওঁদের কথা শুনেই সাতসকালে আদালতে এলেন। কেন যে এ রকম হল, বুঝতে পারলাম না।” খবরটা শোনার পর থেকে থানার লকআপের ভিতরেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন জ্যোতির্ময়। কাঁদতে কাঁদতেই বলেন, “আমি কার উপর পরিবারের ভার দিয়ে যাব। আমি তো শেষ হয়ে গেছি!”
ভেঙে পড়েছেন জ্যোর্তিময়ের স্ত্রী অপর্ণাও। অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে সংসার। শ্রীরামপুরের চাতরার তস্য গলির মধ্যে একতলা বাড়িটির পলেস্তারা খসে পড়ছে। বাড়ির দাওয়ার বসে অপর্ণা বলেন, “শুধু মহাকরণ নয়, গত সাত বছর ধরে ভবানী ভবন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ, শিবপুর বি ই কলেজ, পিজি হাসপাতালকোথায় কাজ করেননি উনি! অনেক সরকারি অফিসারদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। মেয়ের বিয়েতেও অনেকে এসেছিলেন।” মেয়ে জয়তীর বিয়ে হয়েছে পাশের পাড়াতেই। বিপদের সময় তিনি চলে এসেছেন মায়ের কাছে। পাশ থেকে বললেন, “বাবা তো ওখানে গিয়েছিলেন সরকারি নথিপত্র বাঁচাতে। এ তো শূন্য পাপে গুরুদণ্ড হয়ে গেল! এর পরে আমার বাবাকে কে কাজ দেবে বলুন তো?”
নন্দীবাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যেও ঘুরপাক খাচ্ছে এই প্রশ্নটাই। প্রতিবেশী নারায়ণচন্দ্র জানা বলেন, “ও সৎ ভাবে রোজগারের জন্য কী না করেছে! এর পরে কী হবে কে জানে?” এলাকার বাসিন্দারা জানান, ছেলেবেলায় ভাল সাঁতার কাটতেন জ্যোতির্ময়। এনসিসি করতেন। বাবা একটা কাচের কারখানায় সামান্য কাজ করতেন। তাই বেশিদূর পড়াশোনা চালাতে পারেননি। ১৪ বছর বয়স থেকেই রোজগারে নেমেছিলেন। প্রতিবেশীরা বলেন, “কোথাও একটা বড় ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন ভরসা শুধু আদালত।”
অপেক্ষা করে করে মন ভেঙে যাওয়ার পরে এ দিন অসুস্থ বোধ করছিলেন জ্যোতির্ময়ের মা। নাতজামাইয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসেন কোর্টের বাইরে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর ফের অসুস্থ বোধ করায় তাঁকে বসানো হয় একটি গাড়িতে। গাড়িতেই নাতজামাইয়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েন তিনি। পরে কিছুটা সুস্থ বোধ করার পর ওই গাড়িতেই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় হাওড়া স্টেশনে।
রওনা হওয়ার আগে বৃদ্ধা বলে যান, “হার মানলে তো হবে না। শুক্রবার আবার আসব। এ দিন বেশিক্ষণ পুজো করতে পারিনি। শুক্রবার আরও বেশি করে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.