মহাকরণের কেরোসিন-কাণ্ডের ছ’দিনের মাথায় স্বরাষ্ট্র দফতর ও পুলিশি-তদন্তের যে রিপোর্ট নবান্নে জমা পড়ল, তাতে ধৃত জ্যোতির্ময় নন্দীকে কার্যত চক্রান্তের অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। তবে রিপোর্টে এ-ও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ঘটনার দিন স্বরাষ্ট্র-প্রকাশনা বিভাগের অফিসঘরে কীটনাশক ছড়ানোর সময়ে তেমন নজরদারি ছিল না। ফলে অতিরিক্ত কেরোসিন মেঝেয় ছড়িয়ে দিয়ে বড়সড় বিপদের সম্ভাবনা তৈরি করেছিলেন জ্যোতির্ময়। এ ক্ষেত্রে তাঁকে কাজে লাগিয়েছিলেন যিনি, প্রকাশনা বিভাগের সেই রেজিস্ট্রারও দায় এড়াতে পারেন না বলে রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে।
নবান্ন সূত্রের খবর: বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র-সচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে রিপোর্ট দু’টি জমা পড়েছে। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র-প্রকাশনার রেজিস্ট্রার বিস্ময় রায় পুরো বিষয়টি লিখিত ভাবে সচিবকে জানিয়েছেন। তাঁর বিবৃতি ও সরকারি দুই রিপোর্টের নির্যাস হল: গত ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন প্রকাশনা বিভাগের অফিসঘরে কীটনাশকের সঙ্গে কেরোসিন তেল মিশিয়ে স্প্রে করেছিলেন জ্যোতির্ময়বাবু। আগুন লাগানো বা অন্য কোনও উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না। তবে নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা মহাকরণে কোনও পরিচয়পত্র ছাড়া কী ভাবে তাঁকে ঢোকানো হল, কেন তাঁর কাজের সময়ে উপযুক্ত নজরদারি ছিল না, সরকারি রিপোর্টে সে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। কেরোসিন-কাণ্ডে পুলিশের ভূমিকার দিকেও ইতিমধ্যে আঙুল তুলেছে প্রশাসনের একাংশ।
সরকারি রিপোর্টে জ্যোতির্ময়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ না-থাকায় স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে, তাঁর এ বার কী হবে?
নবান্নের এক সূত্রের দাবি: আজ, শুক্রবার জ্যোতির্ময়বাবুকে আদালতে হাজির করা হলে সরকারপক্ষ তাঁর জামিনের আবেদনের বিরোধিতা না-ও করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁর মুক্তির সম্ভাবনা থাকতে পারে। যদিও প্রশাসনের তরফে এই অনুমানের কোনও সমর্থন মেলেনি।
২৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় মহাকরণে স্বরাষ্ট্র দফতরের অধীন রেজিস্ট্রার অফ পাবলিকেশনের অফিসঘরে কেরোসিনের গন্ধ পাওয়া যায়। স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়, এর পিছনে নাশকতার ছক রয়েছে। স্বরাষ্ট্র-সচিবও ‘চক্রান্তের’ অভিযোগ তোলেন। পুলিশ তদন্তে নেমে চার জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরে জ্যোতির্ময়বাবুকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশই জানিয়েছে, হুগলির শ্রীরামপুরের বাসিন্দা ওই ব্যক্তি দীর্ঘ দিন যাবৎ রেজিস্ট্রার অফ পাবলিকেশন বিভাগে কীটনাশক ছড়ানোর কাজ করে আসছেন। পুলিশের দাবি: জ্যোতির্ময়বাবু নিজেই জানিয়েছেন, আগেও তিনি কীটনাশকের সঙ্গে কেরোসিন মিশিয়ে ওখানে স্প্রে করেছেন।
এবং কেরোসিন ব্যবহারের পিছনে অভিসন্ধি ছিল কি না, মূলত তা খতিয়ে দেখতেই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্র-সচিব। এ নিয়ে হেয়ার স্ট্রিট থানা (মহাকরণ যার আওতায়) ও স্বরাষ্ট্রের যুগ্মসচিব দেবাশিস গুহঠাকুরতা আলাদা ভাবে তদন্ত করেন। বাসুদেববাবু এ দিন তদন্ত-রিপোর্ট সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য এড়ালেও দফতরের এক কর্তা বলেন, “দু’টোই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গুরুত্ব বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিরপরাধ কেউ শাস্তি পাক, সেটা কাম্য নয়। কারও কর্তব্যে অবহেলা ছিল কি না, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে যাচাই করা হবে।” তাঁর বক্তব্য: সে দিন জ্যোতির্ময় মহাকরণে কী ভাবে ঢুকলেন, তার সূত্র ধরেই ‘কর্তব্যে অবহেলা’র প্রসঙ্গ এসেছে। জ্যোতির্ময়বাবুর কাছে মহাকরণে ঢোকার বৈধ প্রবেশপত্র ছিল না। পুলিশও তাঁকে কোনও ‘ভিজিটিং পাস’ দেয়নি। সে ক্ষেত্রে তাঁর মহাকরণে ঢোকাটা অনধিকার প্রবেশেরই সামিল। প্রশাসনের একটি অংশের মতে, যিনি ওঁকে ওই কাজে নিয়োগ করেছিলেন, ঘটনায় দায় তাঁর উপরে যেমন বর্তায়, তেমন পুলিশও দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
স্বরাষ্ট্র-প্রকাশনার রেজিস্ট্রার বিস্ময়বাবু তদন্তকারী দেবাশিসবাবুকে স্পষ্টই জানিয়েছেন, জ্যোতির্ময় ‘সম্পূর্ণ নির্দোষ।’ তিনি এ-ও জানিয়েছেন, ফি মাসের শেষ শুক্রবার মহাকরণের গেটে এসে জ্যোতির্ময় তাঁকে ফোন করতেন। এক জন ‘গ্রুপ ডি’ কর্মীকে গেটে পাঠানো হতো, তিনি জ্যোতির্ময়কে ভিতরে ঢোকার ব্যবস্থা করে দিতেন। স্প্রে করার সময়ে এক কর্মীকে সেখানে রাখা হতো, নিরাপত্তার কারণে। বিস্ময়বাবুর দাবি: ঘটনার দিনও একই প্রক্রিয়ায় জ্যোতির্ময় মহাকরণে ঢুকেছিলেন।
বিস্ময়বাবু ওই পদে রয়েছেন ২০০৪ থেকে। বিভাগটি গত জুনে ভবানী ভবন থেকে মহাকরণের জি ব্লকের পাঁচতলায় উঠে আসে। বিস্ময়বাবুর বক্তব্য: জ্যোতির্ময় ভবানী ভবনে গিয়ে স্প্রে করতেন, তাই তাঁকে মহাকরণেও কাজ করতে বলা হয়েছিল। এ বাবদ মাসে ৫০০ টাকা পেতেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে বিস্ময়বাবু অবশ্য কিছু বলতে চাননি। “বিভাগীয় তদন্ত হচ্ছে। কিছু বলতে পারব না।” মন্তব্য তাঁর।
পুলিশও তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ মানতে নারাজ। পুলিশ-কর্তাদের বক্তব্য, বিধির পাশাপাশি কিছু প্রথাও মহাকরণে দীর্ঘ দিন ধরে চালু রয়েছে। টেলিফোন পরিষ্কার, পুরনো ঘড়িতে দম দেওয়া বা কীটনাশক ছড়াতে ঠিকা-কর্মীদের মহাকরণে বৈধ প্রবেশপত্র ছাড়া ঢুকতে দেওয়াটা ওই সব প্রথারই অঙ্গ। “সব নিয়ম কঠোর ভাবে নিয়ম মানতে গেলে তো রোজকার বহু কাজই আটকে যাবে!” মন্তব্য এক পুলিশ-কর্তার। তাঁর দাবি, “জ্যোতিমর্য়বাবু মহাকরণে বার বার আসায় পুলিশের মুখচেনা হয়ে গিয়েছিলেন। ঘটনার দিন মহাকরণের গেটে তাঁকে চিহ্নিত করতে স্বরাষ্ট্র-প্রকাশনার এক কর্মীও নেমে এসেছিলেন। তার পরেই ওঁকে ছাড়া হয়। কেরোসিন ফেলে রাখার দায় পুলিশকর্মীদের নয়।”
পুলিশি-তদন্তে প্রকাশ, কীটনাশক ছড়ানোর জন্য ২০০৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত জ্যোতির্ময়ের সঙ্গে চুক্তি করা ছিল। তার পরে চুক্তি নবীকরণ না-করেই তাঁকে দিয়ে কাজ করানো হচ্ছিল। আর সে দিন যে ঘরে কেরোসিন মিলেছে, সেটি ছুটির পরেও তালা মারা হতো না। ফলে সেখানে যে কেউ, যখন খুশি ঢুকতে পারতেন। এ দিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ মহাকরণের পাঁচতলায় রেজিস্ট্রার পাবলিকেশনের অফিসে আসেন স্বরাষ্ট্র-যুগ্মসচিব দেবাশিসবাবু। তিনি অফিসঘরটি ঘুরে দেখার পরে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং অন্যান্য কর্মীর সঙ্গে কথা বলেন। বিকেলে স্বরাষ্ট্র-সচিবকে রিপোর্ট জমা দেন।
২৯ তারিখে মহাকরণের ওই কেরোসিন-কাণ্ডের খবর কী ভাবে নবান্নে গিয়ে পৌঁছাল, তদন্তে নেমে তা-ও জেনেছে পুলিশ। প্রকাশনা বিভাগের পাশে অবস্থিত জলসম্পদ দফতরের এক কর্মী সে দিন বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ কেরোসিনের তীব্র গন্ধ পেয়ে দফতরের এক উপ-সচিবকে জানিয়েছিলেন। তিনি ফোন করেন পূর্তকে। এক পূর্ত-অফিসার নবান্নে ঊর্ধ্বতন অফিসারকে খবর দেন। সেখান থেকেই খবর যায় স্বরাষ্ট্র-সচিবের কাছে।
এ দিন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, “রাইটার্সে পোকা মারতে কেরোসিন তেল ঢেলেছিল! তাতেও উনি ষড়যন্ত্র দেখলেন! এ যেন হিটলারের রাইখস্টাগ পোড়ানোর মতো ব্যাপার!” |