|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
নিভৃতে অনুভব করা যায় শব্দের গহন ধ্বনি |
আবীর মুখোপাধ্যায় |
কবিতা সমগ্র, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী। সম্পা: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়। দি সী বুক এজেন্সি, ৩০০.০০
কবিতা সংগ্রহ, নিশীথ ভড়। সম্পা: রণজিৎ দাশ। রাবণ, ১২৫.০০
নাস্তিকের জপতপ, দেবদাস আচার্য। আদম, ১০০.০০
শ্রেষ্ঠ কবিতা, বিভাস রায়চৌধুরী। প্রতিভাস, ২০০.০০ |
সমকালকে দেখার শাব্দিক দৃষ্টিকোণে, একজন কবিকে চেনা যায়। নিজেকে উন্মোচনের তাগিদ ও নিরন্তর আত্মখননে গড়ে ওঠে একজন কবির কবিতার নিজস্ব নিখিল। সব সময় যে সেই নিখিলের সকল অর্থ সমকাল জেনে ফেলে তেমন নয়। স্বল্পশ্রুত রয়ে যান কবিদের কেউ কেউ।
রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী সেই কবি। চল্লিশের দশকে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকায় আত্মপ্রকাশ। অথচ, প্রথম কাব্য আরশি নগর-এর প্রকাশ কৃত্তিবাসের উদ্যোগে (১৯৬১)। এই প্রথম কাব্য থেকেই রমেন্দ্রকুমারের কাব্যবিস্তারে নিরুদ্বেগ এক অন্তরযাত্রা দেখি। হয়তো সেই কারণেই, যুদ্ধান্ত সময়ে দাঁড়িয়ে তাঁর কবিতা টালমাটাল সময়ের তথ্য খোঁজে না!
কবি গূঢ় অন্তঃসারকে স্পর্শ করে লেখেন,
‘ঈশ্বর, মোটর, কিংবা বিউগল, কিছুই পারে না তবু দিতে,
যদি-না সমস্ত চেষ্টা শান্ত হয় একটি নারীতে’।
স্মৃতি ও মেধার পথ নিয়েছেন কবি। ‘বৃষ্টির পর রোদ’, ‘আরশি নগর’ অথবা ‘একটি যুদ্ধকালীন জন্ম’ পেরিয়ে নিষ্ঠ পাঠকও পৌঁছে যান ‘আরো শুভ্র রোদে’-এর পথে ‘অলংকৃত তীর’-এ। কবিতা সংগ্রহ-এ কবির দ্বিতীয় একক কাব্য, ব্রহ্ম ও পুঁতির মউরি বা শেষ কাব্যসংগ্রহের ‘তিষ্যপুষ্য’, ‘মাতৃকাবর্ণেরা এস’, ‘ভাদ্রপদ’ পড়তে পড়তে মনে হয়, এই কবির শব্দ শুধু ‘শব্দ’ নয়, শব্দ ‘ত্রিমাত্রিক ও শরীরী’। নিভৃতে অনুভব করা যায় শব্দের এই গহন ধ্বনি।
উত্তাল সত্তর দশকের কবি নিশীথ ভড় তিনটি কবিতার বই রেখে গিয়েছেন। নিজের পায়ের শব্দ (১৯৮৪), খেলার তুচ্ছ প্রতিমা (১৯৮৬) এবং তীর্থসংহার (১৯৮৮)। তাঁর কবিতা সংগ্রহ-এ এই তিনটি কাব্যগ্রন্থ ও অগ্রন্থিত চারটি কবিতা জায়গা করে নিয়েছে। স্বল্পশ্রুত এই কবিরও দেখার ভঙ্গিতে এবং স্বতন্ত্র কাব্যভাষায় ধরা পড়েছে সমকাল। ‘শহরের তলপেটে জমে থাকা গাঢ় অমঙ্গলকে লিখতে বসে’ নিশীথ পৌঁছেছিলেন ‘ধ্বংসের সেই কিনারে, যেখানে মৃদুজ্যোৎস্নার আলো মৃত্যুশব্দে শিকল বাজিয়েছে’ তাঁর কবিতায়। নিষ্ঠ পাঠককে কবি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন ‘কবন্ধ’ এক নগর-জীবনের সামনে। কেন না, ‘ক্লেদাক্ত’ কলকাতা তাঁর কাছে ‘ধ্বংসশহর’। অন্তর্মুখী নিশীথের বাল্যকাল কেটেছিল এই শহরের যৌনপল্লিতে। নিষ্পাপ বাল্যে দেখে ফেলা ‘অসম্বৃত মেয়েছেলের গালে চুমু খেয়ে নেওয়া’ বা
‘রাতে জুয়ো, টাকার আসরে
তিন পায়ে নেচে উঠে রগড়ে চমকে দেওয়া সকলের মুখ’
ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর তিন কাব্যগ্রন্থে। এই সব কবিতায় বাঁশচাপা ভ্যাপসা ঘরে যৌনকর্মী মালতী তার তিন ‘সক্ষম’ যুবক খদ্দেরের দ্বারা ধর্ষিত হয়। ছত্রে ছত্রে ‘ছন্নমানুষের দল ঘুরে বেড়ায় দিগবিদিক’। বহু-ব্যাপ্ত গহন রাতে তারা ‘আগুনের পাশে গোল হয়ে আলোচনা করে
এ বছর শীত খুব বেশি
সব্জির বাজার ভাল নয়
কে কে যেন মারা গেল, কে কে যেন দেশ ছেড়ে এসেছে এবার’।
ছন্দ-নির্মাণ ও ছন্দ-শৃঙ্খল ভাঙায় তুখোড় নিশীথের কাব্যে প্রেম একই সঙ্গে দীপ্তি ও দহনে গাঁথা। এই পর্বে আর যে কবির কথা বলব, তাঁর সকল কবিতায় হয়তো এমনতর শিল্পিত অনুভব নেই। মেধাশাসিত যৌনতা ও নাগরিক স্মার্টনেসও নেই। চরণে চরণে নেই শহরমুখী চিত্রকল্প বা প্রতিতুলনার আধিক্য। কেবল সহজ এক কাব্যভাষাকে সেতু করে এই কবি পৌঁছে যেতে চান পাঠকের কাছে। তিনি আশির দশকের কবি দেবদাস আচার্য। দুটি একটি সহজিয়া শব্দের শীর্ষকের ইশারায় তাঁর নাস্তিকের জপতপ বইয়ে দেবদাস মিতকথনে মহতী ইতিহাসবোধ ও কৃষিচেতনাকে লালন করেছেন পাতায় পাতায়।
কবিতায় সাদামাটা শব্দ ব্যবহারে বিশ্বাস রাখেন নব্বই দশকের কবি বিভাস রায়চৌধুরীও। প্রায় কথা বলার ভঙ্গিতে একটি লাইন থেকে অন্য লাইনে গতি এনে ফেলেন। মাধুর্যময় আর অনায়াস সেই গমনে শব্দের দুর্বোধ্যতা নেই বলেই, এই মগ্নতা। অনর্গল এবং অন্তচারী। যখন বিভাস লেখেন,
‘যে-মেঘ এপারে একা, ভাষাহারা বন্ধু কই ওর?
কবে ভেসে যাব, বলো, রেডিয়োর ঝড়ের খবর’
— তখন মনে হয়, ছন্দের মিতস্বরে ইছামতীর এলোমেলো হাওয়ার খেলা চলেছে একলা দুই পংক্তিতে! সাতটি কাব্য থেকে সংকলিত শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থের সব কবিতাই শ্রেষ্ঠ নয়। তবে ‘সূর্য-পোড়া ছাই’, ‘ছন্দের ভিতরে এত অন্ধকার’-এর মতো কবিতা স্বপ্নপ্রবণ এক কবির আত্মখনন। কেবল পূর্বজদের শ্রেষ্ঠ কবিতার নাম ধার করে শীর্ষকে দারুণ কৌতুক নির্মাণ নয়, মেধা যেন ছন্দে ছন্দে ভর করে ডানা মেলে উড়ে গেছে এই সব কবিতায়। নিজেকে আড়াল করেননি কবি। বার বার এসে পড়া ‘বিশ্বাসঘাতক’ শরীরের কথাতেও না। ‘চণ্ডালিকাগাছ’ কাব্যে বাসনার কাছে নতজানু হয়ে অকপটে ‘জিপসি’-তে তাই লিখতে পারেন,
‘ধূপছায়াগাছ,
তোমাকে পাবার হঠাৎ বাতাস... ইচ্ছে করছে
একবার ছুঁই... একবার ছুঁই...’।
পড়তে পড়তে পাঠক এক সময় কবির সঙ্গে পাশাপাশি ‘ভালোবাসার জন্য দাঁড়িয়ে’ থাকেন চুপচাপ। |
|
|
|
|
|