পুস্তক পরিচয় ১...
সমসাময়িক কাব্যপরিধির বাইরে, একা
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা। সম্পাদনা: গৌতম বসু, ভূমেন্দ্র গুহ। গাঙচিল, ৬৫০.০০
পুরনো বাংলা-ধাঁচের মাটির দোতলা বাড়ি। খড়ে-ছাওয়া। বারান্দার কাঠের কারুকাজে বাড়িটি ছিল আরও প্রাচীন শিল্পশ্রমকে ছুঁয়ে। আমাদের জন্যে বরাদ্দ দোতলার যে-ঘরটি, তার দেওয়ালে জোড়া তাক। কী-সব বই যেন রয়েছে তাকদুটোয়। জানা গেল, বাড়ির এক তরুণ সিউড়ির কলেজে পড়েন, এ সব তাঁরই। তখন আমার সবে ক্লাস টেন, আর এঁরা নতুন আত্মীয়। একটু ইতস্তত ভাব ছিলই। তবু কী করে যেন শুরু হল ঘাঁটাঘাঁটি। সেগুলো ছিল ‘পূর্ব্বাশা’ পত্রিকার নানা সংখ্যা। দুটো দিন কেটে গিয়েছিল ওই সংখ্যাগুলোর সাহচর্যে। আমি পেতাম ‘দেশ’, স্কুলের পাশের দোকান থেকে। ট্রেন থেকে নেমে চার কিলোমিটার গরুর গাড়িতে এই গ্রামে এসে একটি অচেনা পত্রিকার সঙ্গে আলাপিত হয়ে— সেই কলেজপড়ুয়া দাদার প্রতি গোপন একটা টান জন্মালেও— আত্মমর্যাদায় লেগেছিল! সেটা উনিশশো ছেষট্টি-টেষট্টি। ‘পূর্ব্বাশা’র নবপর্যায়। সেই প্রথম পরিচয় সঞ্জয় ভট্টাচার্য নামটির সঙ্গে। আর, তাঁর আজীবনের সুহৃদ সত্যপ্রসন্ন দত্তর সঙ্গেও।
তার পর এত-এত বছর গেল, কখনও বা তাঁর কবিতার গদ্যের দর্শনের আর ইতিহাস-চর্চার প্রসঙ্গে, পূর্ব্বাশা প্রসঙ্গে কখনও কিংবা নিতান্তই জীবনানন্দ দাশের দুর্দিনের অনুষঙ্গ ধরে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের নাম ভেসে উঠলেও সব কিছু ছাপিয়ে কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্পর্কে মনের অতলে কোনও সিক্ত চিহ্ন অঙ্কিত হয়নি। দুষ্প্রাপ্যতার অজুহাতে ধারাবাহিক ভাবে পড়াও হয়নি তাঁর কবিতা। ক্বচিৎ পড়লেও, বাংলা কাব্য পরিমণ্ডলে দীর্ঘ দিন অবহেলিত তাঁর কবিতাগুলি যেন নিজেই বলতে চাইত—
তোমাদের কাছে আমি পৌঁছতেই চাই নি কখনও
আপ্রাণ নিজের কাছে পৌঁছতে চেয়েছি,...।

মৃত্যুর চুয়াল্লিশ বছর পর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা নামের বইটি হাতে পেয়ে তাঁর কবিতারেখার সামগ্রিক রূপটি এই প্রথম আমরা দেখার সুযোগ পেলাম।
সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ২৪ বছর বয়সে কুমিল্লা শহর থেকে ‘পূর্ব্বাশা’-র আত্মপ্রকাশ। লেখালেখির শুরু তারও আগে, একটি গল্প লিখে। প্রথম কবিতাগ্রন্থ সাগর ও অন্যান্য কবিতা ছেপে বেরোয় যখন, কবির বয়স ২৮। তার আগেই তিনি কলকাতাবাসী। জীবদ্দশায় প্রকাশিত শেষ কবিতাবই উর্বর উর্বশী, ৫৪ বছরে।
মোট ১২টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাঁর জীবৎকালে। একটি (সঞ্জয় ভট্টাচার্যের স্বনির্বাচিত কবিতা) বাদে সবগুলোই কোনও না কোনও ভাবে পূর্ব্বাশা ও সত্যপ্রসন্ন দত্তর একক উদ্যোগে। সে সব বই বহু দিন ছিল দুষ্প্রাপ্য। তাঁর মৃত্যুর সিকি শতাব্দী পর এই সে দিন দু’টি কবিতাগ্রন্থ (কথার ভেতর কথা, ২০০১ এবং আলোছায়ার কবিতা, ২০০২) কবি-অনুরাগী ভূমেন্দ্র গুহর প্রচেষ্টায় প্রকাশ পেলেও সঞ্জয় তাঁর সমসাময়িক কবিতাজগতের প্রাণপরিধির বাইরে এক মৃত কালিবাঙ্গানের স্তূপ হয়েই এত দিন মাটির তলায় থেকে গেছেন সুপ্ত। তাঁর কবিতাগুলি এমন বিপজ্জনক প্রবণতা পেয়েছিল তখন থেকেই, যখন তিনি জাতি সভ্যতা ইতিহাস দর্শন বিষয়ে নিজের বিশ্বাস শুধু গড়ে তুলতেই ব্যস্ত ছিলেন না, হয়ে উঠেছিলেন— বাংলায় যাকে বলে— অ্যাক্টিভিস্ট! রবীন্দ্রনাথের পর যত ক্ষুদ্র পরিসরেই হোক না কেন, এমন কাণ্ড কোনও বাঙালি কবি করে ফেলবেন, গড়ে তুলবেন নিজস্ব ছাপাখানা সমেত একটি পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থা, যে সংস্থা রূপায়িত করতে চাইবে তাঁর আদর্শকে— তদুপরি কৃষির উন্নতির জন্য শুধু চিন্তা এবং পরিকল্পনা নয়, গড়ে তুলবেন কয়েক হাজার বিঘের আস্ত একটা মডেল ফার্ম, অর্থাৎ যন্ত্রের হলেও লাঙল চালানোর কারখানা— এতটা মেনে নেওয়া সম্ভবত এখনকার বাঙালির পক্ষেও সম্ভব নয়।
চল্লিশের দশকের প্রথম দু’তিন বছরের মধ্যেই নানা ঘটনা পরম্পরায় হতাশ বাঙালির তত্ত্বচিন্তা আর কর্মোদ্যোগ তথা প্রয়োগ-প্রচেষ্টা যে পৃথক দু’টি পথে হাঁটতে শুরু করেছে, সঞ্জয় ভট্টাচার্য সম্ভবত তা টের পাননি। তিনি ছিলেন এর বিপরীত মেরুতে। এবং কিছু শুভানুধ্যায়ীর সক্রিয় সমর্থন জুটলেও সমাজের সমর্থন তিনি পাননি। দেশভাগও তাঁর কর্মোদ্যোগকে ধ্বংস করার মুখ্য একটি কারণ। এমন বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি তাঁর সমসাময়িক কোনও কবি-লেখককে, যা তিনি নিজে আহ্বান করে এনেছিলেন।
এ তো গেল সঞ্জয় ভট্টাচার্যের চিন্তা আর কর্মজীবনের জটিলতার কথা, যে জটিলতায় তাঁর জীবন ক্ষয়ে-ক্ষয়ে গিয়েছে। আত্মহননের প্রবল চেষ্টা করতে হয়েছে, ঢুকতে হয়েছে মানসিক হাসপাতালে। আর কবিতা? মৃত্যুর তিন বছর আগে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছেন, ‘আমার একটা দুর্নাম আছে প্রথম থেকেই— আমি দুর্বোধ্য, আমি মোটেও প্রাঞ্জল নই, আমায় বোঝা যায় না। এটা হচ্ছে যারা আমার প্রতি, যাকে বলে আক্রমণাত্মক, তাদের কথা। আর যারা বন্ধু হয়ে আমাকে বিপন্ন করেছে, তারা বলেছে যে, ওসব ইন্টেলেকচুয়াল লেখা। ফলে আমার একেবারে পাঠক নেই।’
চারপাশে পাঠক নেই জেনেও নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে কোনও কবি কখন লিখতে পারেন কবিতা? এবং আমৃত্যু?
শেষ কবিতাগ্রন্থ উর্বর উর্বশী প্রকাশের পর বেঁচে ছিলেন ছ’বছর। দেখা যাচ্ছে, ‘পূর্ব্বাশা’ নব পর্যায়ের প্রকাশ আর কবিতাগ্রন্থ উত্তর পঞ্চাশ-এর প্রকাশ একই বছরে, বাংলা ১৩৭০-এ। তার আগের বই সবিতা-র (১৩৬৫) পাঁচ বছর পর। পরের বছর উর্বর উর্বশী (১৩৭১)। জীবনের সবচেয়ে দুর্গম পথটি তখন পেরোতে হচ্ছে তাঁকে, এখন তাঁকে নিয়ে তাঁর সুহৃদ সত্যপ্রসন্ন দত্তকেও। ভয়ঙ্কর মানসিক পীড়া, আশ্রয়হীনতা, আর্থিক অনটন— এমন সব দুর্বিপাকের আবহ থেকে তেমন পরিত্রাণ আর পাননি বাকি জীবন। মানসিক অসুস্থতা থেকে রেহাই পেলেও শরীর গেছে ভেঙে।
তবু বলব, এই সব প্রলয়ঘূর্ণির ভেতর লুটোপুটি খেতে খেতে কখন যে নির্ভার হয়েছে তাঁর কবিমনটি, কখন যে সারা জীবনের বৃহৎ সব প্রকল্পচিন্তা থেকে সরে এসে একৎপর তিনি আশ্রয় নিয়েছেন তাঁর ছেড়ে-আসা নির্জন ভুবনে, জানতে পারি তাঁর কবিতার খাতা থেকে, নামহীন ছোট ছোট কবিতা পড়ে। এই সময় তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় ক্রিয়াশীল। কলকাতার সাহিত্য-পরিবেশ থেকে দূরে, ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়ে লিখেছেন আশ্চর্য সব কবিতা।
এই পর্বটিকে সরল ভাবে দেখতে চাইলে তাঁর মৃত্যুর বছর পাঁচেক আগের একটি কবিতার আশ্রয় নিতে আমরা প্রলুব্ধ হয়ে পড়ব, যার ফলে একমুখী দৃষ্টিতে এক কবির সর্বদর্শী যাত্রাপথটি আবছা হয়ে যেতেই পারে। তবু ‘সত্তার দাবি’ নামের সেই কবিতার ক’টি পঙক্তি পড়ব:
‘আকাশ মন্ত্রের মতো, বৃক্ষ যেন একক প্রার্থনা,
আমি আকাশের নীচে ব্যর্থ, ভিন্নমনা
নিজেকে করেছি ক্ষুণ্ণ তুচ্ছ অনুরাগে।
সত্তার প্রগাঢ় দাবি তাই শেষে জাগে:
আমাতেই আমি যেন হই সমর্পিত।’

এই পর্বে তিনি লিখেছেন এমন সব কবিতা, যা সম্পূর্ণ নিরাভরণ। কখনও বজ্রসম, কখনও মায়াজড়িত, কিন্তু সর্বদা অপলক। একটি ছোট্ট কবিতা—
‘মনের নির্মম চিত্রশালা
ভয়ঙ্কর রঙে হত্যা সংরক্ষণ করে।
অতীত না-ছোড়।
যে-অতীত জন্ম-জন্মান্তরে,
ইতিহাসে, প্রাক্-ইতিহাসে গেয়ে গেছে একই পালা।
কোনও আলো নেই তা’র রাত্রি করে ভোর।’

বাক্যকে তীক্ষ আর নির্ভার করার আপ্রাণ চেষ্টা এই সময়ের প্রায় সমস্ত লেখাতেই পাই। একটি কবিতার শুরু এই ভাবে—
‘এই দিঘি জল এক তরুণীর ছায়া নিয়ে খেলে!’ আর একটি—
‘তুমি তো মায়ের পাশে এখনও বালিকা হয়ে থাকো,
একা হলে যৌবন দেখাও
এবং তা দিতে চাও।’

এক নতুন সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ৮০৮ পৃষ্ঠার এই সংকলনগ্রন্থটির প্রকাশ না হলে যাঁকে আমরা পেতামই না হয়তো, বা আমাদের আরও দেরি হয়ে যেত পেতে।
মানুষের ইতিহাস যে শুধুমাত্র ব্যর্থতার ইতিহাস নয়, সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা-র মুখোমুখি হয়ে আবার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে সে-কথা। কী আন্তরিক শ্রমে সম্পাদকদ্বয় গৌতম বসু আর ভূমেন্দ্র গুহ সংকলনটি নির্মাণ করেছেন, উদ্ধার করেছেন অজস্র অগ্রন্থিত— এমনকী অপ্রকাশিত— কবিতা, কবির চিঠিপত্র, কখনও দরকারি বিকল্প-পাঠের পরিচয় দিয়েছেন, জীবনীপঞ্জি-সহ লিখেছেন ভূমিকা আর ভাষ্য। ‘নিবেদন’ অংশে গৌতম বসুর দীর্ঘ রচনাটি খুঁটিয়ে পড়লে তবেই সেই আন্তরিকতা ও মেধার সম্মান জানানো সম্ভব। এই বইটি পাঠকের কাছে সেই সম্ভাবনাটুকু আশা করছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.