|
|
|
|
ইতিহাসের দূরত্ব ও নৈকট্য
আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় |
নেলসন ম্যান্ডেলার কলকাতায় আসাকে কেন্দ্র করে শহরে যে বিপুল উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয়েছিল, তার তীক্ষ্ণ স্মৃতি আজও অমলিন।
সাধারণত, এ ধরনের রাষ্ট্রিক সফর ঘিরে সরকারি আধিকারিকদের স্মৃতি খুব তীক্ষ্ণ থাকে না। তার একটা কারণ যদি হয় আয়োজনের বাহুল্য, তা হলে অন্যটা প্রোটোকলের আতিশয্য। তবুও ম্যান্ডেলার স্মৃতি আমার মনে যে আজও অমলিন, তার পিছনে প্রধানত তিনটি কারণ বলতে পারি।
প্রথমেই বলব, তৎকালীন রাজ্যপাল এবং ইতিহাসবিদ নুরুল হাসানের কথা। নেলসন ম্যান্ডেলার কলকাতায় আসা নিয়ে তিনি বিপুল আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। সাধারণত, রাজ্যপালেরা এ ধরনের রাষ্ট্রিক সফর ঘিরে ব্যক্তিগত স্তরে এতটা আগ্রহ দেখান না। অন্তত, আমার মতো সরকারি অফিসারদের ডেকে অতিথির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে বিশদ চর্চায় যান না। কিন্তু নেলসন ম্যান্ডেলার ক্ষেত্রে নুরুল হাসান সেটা করেছিলেন।
তখন আমি রাজ্য সরকারের আন্ডার সেক্রেটারি এবং স্টেট প্রোটোকল অফিসার। মনে আছে, আমায় রাজভবনে ডেকে একান্তে টানা দু’ঘণ্টা নেলসন ম্যান্ডেলা ও গাঁধীর ঐতিহাসিক ভূমিকা নিয়ে কথা বলেছিলেন নুরুল হাসান। তখন আমার বয়স মাত্র ২৯। সেই বয়সেই আলোচনার সুযোগে ইতিহাসবিদ নুরুল হাসানকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে গাঁধী না ম্যান্ডেলা, কাকে এগিয়ে রাখবেন তিনি?
এখনও মনে আছে, প্রশ্নটা শুনে কিছু ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে ছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল। তার পর বলেছিলেন, “এ নিয়ে শেষ বিচারের সময় এখনও আসেনি। এ ব্যাপারে শেষ কথা বলবে ইতিহাস-ই। ইতিহাস আরও একটু দূরত্ব চায়।”
পরবর্তী কালে আর কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে রাজভবনের চত্বরে এতটা ইতিহাস-বীক্ষা নজরে আসেনি।
আমার অমলিন স্মৃতির তীক্ষ্ণতার দ্বিতীয় কারণটা আর একটু ব্যক্তিগত। নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে সমাজের সর্ব স্তরের মানুষের যে উদ্দীপনা দেখেছিলাম, তার কিছুটা প্রভাব পড়েছিল আমার বাড়িতেও। সে দিন সকলেই ইডেনের অনুষ্ঠানের একটি কার্ড পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। আমার স্ত্রী সাধারণত অন্তর্মুখী এবং এই ধরনের কোনও রাষ্ট্রিক অনুষ্ঠানে যেতে চান না। তিনি-ও নেলসনকে দেখার জন্য তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু অনুষ্ঠানের কার্ডের অভাবে তাঁকে আমি নিয়ে যেতে পারিনি। এখনও পর্যন্ত আমার স্ত্রী-র জীবনে একটাই আফশোস, নেলসনকে দেখতে না পারা। বস্তুত, তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা বলে ম্যান্ডেলার মতো রাষ্ট্রপুরুষকে না দেখার একটা চিরস্থায়ী আক্ষেপ তাঁর মনে আজও কাজ করে। এই ব্যাপারটা আমি আরও কয়েক জনের মধ্যে দেখেছি। আমার কর্মজীবনে অন্য কোনও রাষ্ট্রপুরুষকে নিয়ে ব্যক্তিগত উন্মনা ভাবের এত প্রাবল্য আর কখনও দেখিনি।
তৃতীয় যে কারণে ম্যান্ডেলাকে বারবার মনে পড়ে, সেটা তাঁর আশ্চর্য, নির্ভার, গণতান্ত্রিক সহজতা। মনে আছে, তাঁর প্রতিনিধি দলের প্রত্যেকের সঙ্গে সমান ভাবে স্বচ্ছন্দে এবং সহাস্যে তিনি কথা বলছিলেন। আমার এখনও মনে আছে, দক্ষিণ আফ্রিকার এক মহিলা প্রতিনিধি, তাঁর ব্যক্তিত্বের দ্বারা কিছু মাত্র বিচলিত না হয়ে, বেশ হইহই করেই মজা করে যাচ্ছিলেন। প্রোটোকল-দূরস্ত রাষ্ট্র-ব্যাপারে এই ধরনের বর্ণময়তা একটু আশ্চর্য ব্যাপার। একই রকম রঙিন সহজতা পেয়েছিলাম আমরাও। ম্যান্ডেলা আমাদের অনেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে সহাস্যে ছবি তুলেছিলেন এবং একটু-আধটু আন্তরিক কথাও বলেছিলেন। কলকাতা এবং বঙ্গভূমি সম্পর্কে তাঁর বোধ হয় কিছুটা জানা ছিল। তার ফলে তিনি একটু যেন বেশি আন্তরিক ব্যবহার করেছিলেন।
এই সব মিলিয়েই ম্যান্ডেলার ঐতিহাসিক সফর আমাদের বেশ নাড়া দিয়েছিল। সেই সঙ্গেই বলব,এখন এত দূর থেকে মনে হয়, আসলে ম্যান্ডেলার আসাকে কেন্দ্র করে আরও অনেক ঐতিহাসিক বেদনা এবং আত্ম-অনুসন্ধানেরও বোধ হয় সূচনা হতে পারত। সেটা যে হয়নি, তার জন্য ইদানীং একটু আক্ষেপ হয়।
|
(লেখক বর্তমানে রাজ্যের পরিবহণ ও আবাসন সচিব।) |
|
|
|
|
|