|
|
|
|
নেলসনের গলা এক বার শুনলে ভোলা যায় না
বিকাশ সিংহ |
১৯৯৫ সাল। কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা। সাইক্লোট্রন-এর বিশ্বসভা বসেছে। কলকাতার সাইক্লোট্রনের অধিকর্তা হিসেবে আমার নিমন্ত্রণ ছিল। সভা উদ্বোধন করবেন নেলসন ম্যান্ডেলা। আমরা উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিলাম না। আমি একমাত্র ভারতীয়। সামনের সারিতে বাঁ দিকের শেষ চেয়ারটা আগে থেকে দখল করে নিলাম কায়দা করে। হিসেব করে দেখলাম, নেলসন ম্যান্ডেলা ঠিক পাশ দিয়েই যাবেন এবং ওই রাস্তাতেই সভাস্থল থেকে বেরোবেন।
আমার কোনও ধারণাই ছিল না যে, মানুষটির চেহারা রাজার মতো। বিস্তৃত বক্ষ, লম্বায় ছ’ফুটের উপরে। পরনে সেই পরিচিত রংচঙে শার্ট। হাঁটার ধরনটাও রাজকীয় মন্থর, কিন্তু সুনিশ্চিত। প্রশস্ত ললাট, ঠোঁটে যেন মৃদু হাসি। জেলখানা থেকে সদ্যই বেরিয়ে এসেছেন তখন। নড়বড়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে স্থির করবার চেষ্টা করছেন সুমধুর দৃঢ়তার সঙ্গে। ওই নিদারুণ কষ্টের জীবন কারাগারের ভেতরে কাটিয়েছেন, কুড়ি বছরেরও বেশি। কিন্তু মুখে সেই মৃদু হাসি।
রাগ-অভিমান-ঘৃণার বিন্দুমাত্র ছাপ নেই ওই দুই উজ্জ্বল চোখে বা ললাটের ভ্রূকুটিতে। শান্ত সৌম্য সেই মূর্তি।
প্রাথমিক বক্তৃতার পরই বিরাট মানুষটি উঠে দাঁড়ালেন, বিশ্বসভা উদ্বোধন করবেন। ব্যক্তিত্বের শোভা সভাকে ছাপিয়ে উঠেছে। চাপা কৌতূহলে, আনন্দে আশ্চর্য মুহূর্তের মহিমা বোঝার চেষ্টা করছে সবাই। আমার বন্ধুবর জন স্যাফিশেভার (দক্ষিণ আফ্রিকা সাইক্লোট্রন কেন্দ্রের অধিকর্তা) ম্যান্ডেলা সাহেবের বক্তৃতার বিষয়বস্তু লিখে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। একটুখানি, সাধারণ আপ্যায়ন জানিয়েই জন সাহেবের লিখিত লিপিটিকে টেবিলে রাখলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। প্রাণের ভিতর থেকে লুকিয়ে রাখা কথাগুলি ঠিকরে বেরিয়ে এল। এখনও সেই শব্দের ধ্বনি বহু যুগের ও পার হতে কানে বাজছে: ‘When I was in the prison in Robben Island for many years... we heard about the news beyond the confined bars of the prison, the exciting developments in Particle Physics...’ বিশ্বসভায় যাঁরা এসেছেন, আমিও তার মধ্যে এক জন। গম্ভীর, উদাত্ত কণ্ঠের ওই কথাগুলি শুনে অশ্রু সংবরণ করা খুবই শক্ত ছিল। যত দূর মনে পড়ে, সে দিন তিনি বলেছিলেন, বিজ্ঞানের ওই ঐতিহাসিক আবিষ্কার যে এক মহা আনন্দ আর অসীম তৃপ্তির যজ্ঞ শুরু করে দেয়, তারই চিরপ্রদীপ ওঁকে কারাগারের দিনগুলি পার করার শক্তি দিয়েছিল।
দেশের ডাক থাকায়, উনি বক্তৃতার পরই চলে যাবেন। ঠিক আমার পাশ দিয়েই যাবেন। সাহস করে উঠে দাঁড়ালাম, ‘Sir, I come from India.’ শক্ত হাতে করমর্দন: ‘You come from India, land of Mahatma Gandhi.’ ওই গলা এক বার কাছ থেকে শুনলে কোনও মানুষ জীবনেও ভুলতে পারবে না। ‘Give my greetings.’ ‘Yes Sir.’ চলে গেলেন ওই এক চালে। মন্থর গতি, সুনিশ্চিত দৃঢ় পদক্ষেপ।
হঠাৎ মাথায় কী পাগলামি ঢুকল ওই সভায় বসে বসেই প্রেসিডেন্ট ম্যান্ডেলাকে চিঠি লিখে বসলাম, ‘আমি আপনার বক্তৃতায় এতই অভিভূত ইত্যাদি ইত্যাদি।’ শেষে মোদ্দা কথায় এলাম যে, ‘আপনার সই করা একটি ছবি আমার চাই, আমি সেটি যত্ন করে আমার বাড়িতে রাখব।’
সহকর্মীরা শুনে হেসে আকুল। টিপ্পনী কেটে তারা বলতে লাগল যে, আমার মস্তিষ্কের ভাল রকমের বিকৃতি ধরা পড়েছে। অবশ্যই ভ্রূক্ষেপ করিনি।
এক মাসের মধ্যে কলকাতায় আমার বাড়িতে বড় খামে একটি পার্সেল এল। সুন্দর একটি চিঠি আর একটি অপূর্ব ছবি। নেলসন ম্যান্ডেলা তাকিয়ে আছেন। মুখে সেই মৃদু হাসি। যখনই কলকাতায় থাকি, সেই ছবিটিকে দিনের মধ্যে এক বার দেখতেই হবে।
নেলসন ম্যান্ডেলা মহাপ্রস্থানে। কিন্তু ওই মৃদু হাসি, সে তো চিরকালের।
|
(লেখক ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার-এ হোমি ভাবা অধ্যাপক।) |
|
|
|
|
|