|
|
|
|
কয়েদি নম্বর ৪৬৬৬৪,
রবেন
দ্বীপে ১৮ বছর পার এই পরিচয়েই
সংবাদ সংস্থা • কেপ টাউন
৬ ডিসেম্বর |
সাত ফুট বাই দশ ফুট। এই ঘুপচি কুঠুরিটাই এক কালে ঠিকানা ছিল কালো মানুষটার। নেলসন ম্যান্ডেলা। এক-আধ বছর নয়, এক টানা আঠারো বছর! ঘরটা এতটাই ছোট যে হাঁটাচলা করাই দায়। মুক্তির পরে কারাবাসের দিনগুলি নিয়ে গল্প করতে গিয়ে নিজেই ঠাট্টার সুরে বলতেন, “ঘরটা এত ছোট ছিল যে তিন পা যেতে না যেতে ধাক্কা খেতে হত দেওয়ালে!”
রবেন দ্বীপ। কেপটাউন থেকে নদীপথে মিনিট কুড়ির দূরত্ব। এখন প্রতি দিনই সেখানে ভিড় জমান দেশ-বিদেশের পর্যটকরা। বিখ্যাত বন্দির দৌলতে এখন কম বিখ্যাত নয় তাঁর এককালের জেলখানাও। দীর্ঘ ২৭ বছরের বন্দিজীবনের প্রথম আঠারো বছর যে এখানেই কাটিয়েছিলেন ‘মাদিবা’ নেলসন। পরিচয় একটাই, কয়েদি নম্বর ৪৬৬৬৪। |
 |
 |
রবেন আইল্যান্ডের এই খুপরি
ঘরেই ১৮ বছর
কাটিয়েছিলেন
নেলসন ম্যান্ডেলা। ছবি: দেবদূত ঘোষঠাকুর। |
মুক্তির পরে কেপটাউনের এই বাড়িতেই প্রথম
প্রকাশ্যে বক্তৃতা দেন ম্যান্ডেলা।
গ্রহণ করেন
জনগণের অভিবাদন। ছবি: দেবদূত ঘোষঠাকুর। |
|
১৯৯৭ সালে ম্যান্ডেলার এই পুরনো আস্তানাকে হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জেলের প্রাক্তন বন্দিরাই এখন পর্যটকদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখান প্রেসিডেন্টের অতীত। হাল্কা সবজে দেওয়ালের ছোট্ট ঘুপচি কুঠুরি। একটা ভাঁজ করা কম্বল, সবুজ রঙের কাঠের টুল, লাল রঙের বালতি, কাপ আর অ্যালুমিনিয়ামের প্লেট নেলসনের সম্বল বলতে যা কিছু ছিল, এখনও যত্ন করে ঘরে রাখা আছে সে সবই।
রবেন দ্বীপে ম্যান্ডেলা প্রথম পা রাখেন ১৯৬৪ সালে। একে তো কৃষ্ণাঙ্গ। তার উপর সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র চালাচ্ছিলেন। সব দিক থেকে একেবারে ‘নিকৃষ্টতম বন্দি’। তাই খাবারের ভাগ সব সময়ই বাকিদের চেয়ে কম। পরার জন্য মিলত না একটা ফুলপ্যান্টও। হাফপ্যান্ট আর একটাই শার্ট বরাদ্দ ছিল তাঁর জন্য। আপন জন কেউ দেখা করতে আসতে পারতেন তাঁর সঙ্গে, কিন্তু বছরে মাত্রই এক বার!
কুঠুরির বাইরে টানা বারান্দায় ঝোলানো থাকে একটা সাদা-কালো ছবি। জ্যাকেট গায়ে দলেরই আর এক নেতা ওয়াল্টার সিসুলুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শার্টের উপর জ্যাকেট চাপানোর অধিকার ওই এক দিনই মিলেছিল তাঁদের। তিনি থাকার সময়েই এক দিন বন্দিদের অবস্থা দেখতে রবেন দ্বীপে এসেছিলেন রেড ক্রসের প্রতিনিধিরা। এত সাজো সাজো রব সে কারণেই।
আধপেটা খাওয়া, জামা কাপড়ও তথৈবচ, তার উপর নিত্য লেগে থাকত হেনস্থার পালা। জেল ওয়ার্ডেনদের খারাপ ব্যবহার, নির্দেশ পালনে এক চুল এ দিক ও দিক হলেই কড়া শাস্তি। তার সঙ্গে উদয়াস্ত পরিশ্রম। পাথর ভাঙার কাজ করতে নিয়ে যাওয়া হতো বন্দিদের। অস্ত্র উঁচিয়ে তাদের পাহারা দিত এক দল রক্ষী।
এই বিভীষিকাময় জীবনও শেষ পর্যন্ত অবশ্য হার মেনেছিল ম্যান্ডেলার ইচ্ছেশক্তির কাছে। খনির মাটিতে বই, খবরের কাগজ লুকিয়ে রাখতেন তিনি। বাইরের দুনিয়ার হাল হকিকত বন্দিরা যাতে জানতে পারেন, জোর দিতেন তার উপরেও।
সরকারের কাছে ভয়ঙ্করতম বন্দি থেকে দেশের মানুষের চোখের মণি হয়ে ওঠা, বর্ণময় ম্যান্ডেলা-জীবনে এই কারাবাসের মুহূর্তগুলো কী ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিল, সে কথা নিজেই বলতেন নেলসন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮২, একটাই ঘরে কাটানোর পর পোলসমুর জেলে পাঠানো হয় তাঁকে। সেখান থেকে ভিক্টর ভারস্টর জেল হয়ে অবশেষে মুক্তি ১৯৯০-এ। |
 |
সেই কারাগারে ক্লিন্টনের সঙ্গে, ১৯৯৮। রয়টার্সের ফাইল চিত্র। |
সরকার বদলাতে এক কালে হিংসার পথ বেছে নিয়েছিলেন যে কৃষ্ণাঙ্গ, জেল ছাড়ার সময় আমূল বদলে গিয়েছিলেন সেই মানুষটাই। ঢোকার দিন কড়া চোখে তাকিয়েছিলেন যে রক্ষীরা, শান্তির দূতের সঙ্গে এক বার হাত মেলাতে তাঁর মুক্তির সময় সারি দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরাই। হিংসা থেকে শান্তির পথে তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল যে দীর্ঘ কারাবাস, তাকে আঁধার হিসেবে তিনি দেখবেন কী করে! সত্যিই তো, এখান থেকেই তো শুরু হয়েছিল তাঁর জীবনের জয়যাত্রা। |
|
|
 |
|
|