|
|
|
|
শোকের পাশাপাশি ‘টাটা’র জয়ও উদযাপন করল জনতা
সংবাদ সংস্থা • জোহানেসবার্গ
৬ ডিসেম্বর |
সেই সকাল থেকে আকাশের মুখ ভার। যে কোনও মুহূর্তে নামতে পারে বৃষ্টি। মাঝে মধ্যে মৃদু হাওয়া বইছে। আর তাতেই উড়ছে পতাকা। এক, দুই, তিন, চার... অগুনতি। মেঘঢাকা জোহানেসবার্গের রাস্তায় এখন শুধুই মানুষের ঢল। প্রত্যেকেই পতাকা হাতে অতিবৃদ্ধ ‘টাটা’ (পিতা)কে শেষ বিদায় জানাতে এসেছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকা মনে রেখেছে, চামড়ার রঙের ফারাক মুছতে প্রাণপণ লড়েছিলেন এই মানুষটি। পেরেওছিলেন। সেখানেই তো তাঁর জয়। ম্যান্ডেলার শেষ বিদায়ে তাই সেই জয়কেও মনে করালেন জোহানেসবার্গের মানুষ। শোকের পাশাপাশি উদ্যাপনের রঙও ঘিরে রইল তাঁর জোহানেসবার্গের বাড়ি।
খবরটা এসেছিল বৃহস্পতিবার রাতে। শুক্রবার সকাল থেকেই জোহানেসবার্গের রাস্তায় ভিড় জমাতে থাকে। কারও হাতে মোমবাতি, কারও হাতে ম্যান্ডেলার বিশাল বড় পোস্টার। অবিশ্বাসের ঘোর তখনও কাটেনি। নাগাড়ে কেঁদে চলেছেন অনেকে। এমনই এক জন টোনি কারুইরু বললেন, “জানতাম উনি এক সময় আমাদের ছেড়ে যাবেনই। কিন্তু আশা করেছিলাম উৎসবের মরসুমটুকু অন্তত আমাদের সঙ্গে কাটিয়ে যাবেন।” প্রিয় ‘মাদিবা’র (বাড়িতে এই নামেই ডাকা হত ম্যান্ডেলাকে। যে উপজাতির সদস্য ছিলেন ম্যান্ডেলা, সেই উপজাতির ব্যবহৃত ভাষাতেই এই নামে ডাকা হত তাঁকে) বাড়ির সামনে একে একে মালা, মোমবাতি, ছবি রেখে গেলেন সকলে। পিছিয়ে রইল না খুদেরাও। ম্যান্ডেলার বাড়ির সামনে তারাও লিখেছে শেষ বার্তা “উই লাভ ইউ ম্যান্ডেলা’। হয়তো ‘মাদিবা’র লড়াইটা দেখেনি। তারা জানে, জোহানেসবার্গের বাড়িতেই জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাটিয়েছেন ম্যান্ডেলা।
শুক্রবার অবশ্য আরও একটি ছবি দেখেছে জোহানেসবার্গ। উদ্যাপনের ছবি। জেলের কয়েদি থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হওয়ার গল্প কোনও আম আদমির সাদা-কালো জীবনকাহিনি হতে পারে না। বর্ণবিদ্বেষকে হঠিয়ে বর্ণসাম্য প্রতিষ্ঠা করা না, এটাও কোনও সাধারণ গল্প নয়। জোহানেসবার্গের বহু বাসিন্দার চোখে ম্যান্ডেলা তাই ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। তাঁর মৃত্যুর পর দিনও তাই ম্যান্ডেলার বেঁচে থাকাটাকেই যেন উদ্যাপনই করলেন তাঁরা। গলা ছেড়ে গাইলেন কেউ, কেউ নাচলেন। সবার গলাতেই স্বাধীনতার সুর, জাতীয় সঙ্গীত। ষাট-সত্তরের দশকে বর্ণবিদ্বেষ-বিরোধী যে সব গান ঘুরত লোকের মুখে মুখে, সে সব গানও আজ এত দিন পরে শোনা গেল অনেকের গলায়। সবই মিলেছে ম্যান্ডেলার দৌলতে।
জোহানেসবার্গের পাশে একটু বেমানান সোয়েতোর ছবিটা। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে এখানে থাকতেন ম্যান্ডেলা। তখনও তিনি গোটা দেশের আদরের ‘মাদিবা’ হয়ে ওঠেননি। শুক্রবার সকালের আগে পর্যন্ত সোয়েতোর বাসিন্দারা জানতেনই না যে তাঁদের প্রাক্তন প্রতিবেশীটি আর নেই। খবরটা পাওয়ার পরে শোক আর বাঁধ মানেনি। ম্যান্ডেলার সেই লাল ইটের বাড়ির সামনে ভিড় জমান বহু মানুষ। প্রত্যেকের হাতে ছিল বিশাল পোস্টার। স্বাধীনতার গান গেয়েছেন ওঁরাও। তবে প্রায় নীরবে।
শুধু শহর নয়, এ দিন যেন থমকে গিয়েছিল গোটা দেশটাই। বা বলা ভাল গোটা বিশ্ব। আমেরিকা, ব্রিটেন-সহ অনেক দেশেই এ দিন ম্যান্ডেলার স্মৃতিতে পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়।
কিন্তু সব পেরিয়ে বছর ষোলোর মাইকেল লোরির প্রতিক্রিয়াই যেন ফিরে ফিরে এসেছে। জোহানেসবার্গের এই কিশোর স্বচক্ষে ‘মাদিবা’র লড়াই দেখেনি। শুধু মায়ের মুখে শুনেছে সে সব দিনের গল্প। আর তাতেই তার প্রতিক্রিয়া, “ভাবতেও পারি না এমন কোনও দেশ থাকতে পারে, যেখানে শুধু মাত্র শ্বেতাঙ্গ বন্ধুই থাকা সম্ভব!’’ পরবর্তী প্রজন্মকে এই ভাবনার উত্তরাধিকারই দিয়েছেন ‘মাদিবা’। বন্ধু তথা আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটুর বয়ানে, “দু’ভাগে বিভক্ত দেশকে জুড়তে শিখিয়েছিলেন ম্যান্ডেলাই।” মৃত্যুর পর দিন, তার পর দিন, এমনকী তারও পরে সেই উত্তরাধিকার উদ্যাপন করবে আফ্রিকা। |
|
|
|
|
|