|
|
|
|
সহমত পরিবার, শৈশবের গ্রামে হবে শেষকৃত্য
সংবাদ সংস্থা • জোহানেসবার্গ
৬ ডিসেম্বর |
গান গাইছিলেন তাঁরা। তালে তাল মিলিয়ে, পা ঠুকছিলেন সবাই মিলে। “তোমার মতো, এ ভুবনে, আর কেউ নেই।”
এমনিতে আনন্দের গান এটা। কিন্তু আজ যেন তার সুরে মিশে গিয়েছে বেদনার ছায়া। গানের ফাঁকে ফাঁকে সবাই যে কাঁদছেন, “আমরা পিতৃহারা হলাম, মাতৃহারাও। তাঁকে ছাড়া আমাদের কী করে চলবে!”
বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় রাত ৮টা ৫০ মিনিটে মারা গিয়েছেন নেলসন রোলিহলালা ম্যান্ডেলা। শুক্রবার ভোর রাতে সেই খবর জানাজানি হতেই, ৯৫ বছর বয়সী রাষ্ট্রনায়কের বাড়ির সামনে অসংখ্য মানুষের ঢল। সকলের মুখে একটাই কথা “আমরা অনাথ হলাম।” নেলসন ম্যান্ডেলার মৃত্যুসংবাদ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাও বলেন, “এ দেশের মানুষ তাদের পিতাকে হারাল।”
বছর কুড়ি আগে, ১৯৯৪ সালের ১০ মে, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। বর্ণবিদ্বেষ জমানার শেষ শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট, এফ ডব্লিউ দ্য ক্লার্ককে পাশে নিয়ে ৭৫ বছর বয়সী ম্যান্ডেলা সে দিন বলেছিলেন, “এত দিন পরে, অবশেষে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি আমরা। বর্ণবিদ্বেষের সন্ধে আর এ দেশে কখনও আসবে না।” |
|
জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে শোক, শুক্রবার কেপটাউনে। ছবি: এপি। |
কথা রেখেছিলেন তিনি। রাজনৈতিক দক্ষতায় সামলেছিলেন দেশের ক্ষমতাসীন শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীকে। বর্ণবিদ্বেষের বীজ যে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, দেশের সব থেকে বিত্তবান সম্প্রদায় যেখানে শ্বেতাঙ্গ, সামরিক বাহিনীও যেখানে শ্বেতাঙ্গদের হাতে, সেখানে প্রশাসনকে ধীরে ধীরে, ধাপে ধাপে ‘কালো’ করে তুলেছিলেন নেলসন। রবেন দ্বীপে ২৭ বছরের দীর্ঘ বন্দিজীবন, আর মুক্তির পরের রক্তহীন সংগ্রামের বিনিময়ে এ দেশে নতুন সূর্যের ভোর এনেছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা তাই তাঁকে ডাকত ‘টাটা’ বলে। ম্যান্ডেলার মাতৃভাষা ‘জোসা’তে ‘টাটা’ মানে বাবা। মাত্র পাঁচ বছর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। কিন্তু জাতির জনক থেকে গিয়েছেন জীবনভর।
ফুসফুসের সংক্রমণে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন। ২০১০-এ বিশ্বকাপ ফুটবলের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে সরকারি ভাবে তাঁকে শেষ বার দেখা গিয়েছিল। গত ক’বছরে যত বার টিভির পর্দায় এসেছেন, শীর্ণ-রোগগ্রস্ত দেখিয়েছে ‘টাটা’কে। ঝকঝক করত শুধু তাঁর পরিচিত হাসিটা। সেই হাসির আড়ালেই হয়তো লুকিয়েছিল ব্যক্তিগত জীবনের যন্ত্রণা। তিন স্ত্রী, ছয় সন্তান এবং সতেরো জন নাতি-নাতনি সমৃদ্ধ ম্যান্ডেলার পরিবার। কিন্তু ম্যান্ডেলার জীবদ্দশাতেই সেই পরিবারে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় বছর কয়েক আগে, ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য-বিতর্কে।
মৃত্যুর পরে নেলসনকে কোথায় সমাহিত করা হবে, তাই নিয়ে ম্যান্ডেলা পরিবারে ঘোর কাজিয়া লেগে গিয়েছিল। এক দিকে ম্যান্ডেলার প্রথম পক্ষের নাতি মান্ডলা। অন্য দিকে দুই স্ত্রী উইনি ও গ্রাচা। ইতিমধ্যেই ম্যান্ডেলার কয়েক জন ছেলেমেয়ে মারা গিয়েছেন। তাঁদের শায়িত করা হয়েছিল কুনু গ্রামে। যে গ্রামে ম্যান্ডেলার শৈশবের বছরগুলো কেটেছিল। কিন্তু মান্ডলা চাইছিলেন, মৃত্যুর পরে তাঁর ঠাকুর্দাকে সমাহিত করা হবে জন্মস্থান মাভেজোতে। অন্য আত্মীয়দের না জানিয়ে, বাবা-পিসির কবর কুনু গ্রাম থেকে রাতারাতি মাভেজোতে নিয়ে আসেন মান্ডলা। যাতে মৃত্যুর পরে মাভেজাতে সমাহিত করলে ছেলেমেয়েদের পাশেই ঠাঁই হয় ম্যান্ডেলার। কবর-বিতর্ক আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কোর্টের রায়ে অবশ্য ম্যান্ডেলার ছেলেমেয়ের কবর ফিরিয়ে আনা হয় কুনু গ্রামেই। |
|
ভুগছিলেন দীর্ঘদিন ধরেই। বৃহস্পতিবার ভোররাতে খবর এল নেলসন ম্যান্ডেলা আর নেই।
বছর দশেক আগে তাঁর ৮৫তম জন্মদিনে তোলা এএফপি-র ফাইল চিত্র। |
ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পরে অবশ্য সহমত হয়েছেন পরিবারের সকলে। ১৫ ডিসেম্বর, রবিবার, পাহাড়ি গ্রাম কুনুতেই তাঁর শেষকৃত্য হবে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা। প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য বেশ কিছু দিন ধরেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, তিনি আর বেশি দিন নেই। তাঁর মৃত্যুতে দেশে যে আন্তর্জাতিক রথী-মহারথীদের ঢল নামবে, তা-ও প্রত্যাশিতই । ক’বছর ধরে কুনুর সব থেকে কাছের বিমানবন্দর, মাথাথা-কে সাজিয়েগুছিয়ে নেওয়া হচ্ছিল।
সে রাস্তা ধরেই ক’দিন বাদে আন্তর্জাতিক দুনিয়া হাজির হবে কুনু গ্রামে। আসবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা। ম্যান্ডেলার মৃত্যুর পরে যাঁর প্রতিক্রিয়া, “ম্যান্ডেলা আর আমাদের নন, তিনি কালের।” যে সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট বর্তমান, আসতে পারেন প্রত্যেকেই। ম্যান্ডেলাকে ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলেছিলেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট, সেই রোনাল্ড রেগন ২০০৪-এ মারা গিয়েছেন! আসবেন বিল ও হিলারি ক্লিন্টন। তার আগে, ১১-১৩ তারিখ ম্যান্ডেলার দেহ শায়িত থাকবে প্রিটোরিয়ার সরকারি ভবন ‘ইউনিয়ন বিল্ডিং’-এ। সরকারি শোকপালন তো রয়েইছে। প্রেসিডেন্ট জুমার আর্জি দেশের সব গির্জা-মসজিদে, সকলের বাড়িতে, যে যাঁর মতো করে শোক পালন করুন। ব্যক্তিগত উচ্চারণে কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠুক “এ দশের জন্য, এ বিশ্বের জন্য ম্যান্ডেলা যা করেছেন, তার স্মরণে।”
শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়, কৃতজ্ঞতায় নতজানু গোটা বিশ্ব। ওয়েব দুনিয়ায় তাই আজ ম্যান্ডেলা-স্মরণে ৭০ লক্ষ টুইট। |
|
|
|
|
|