|
|
|
|
নেলসন ম্যান্ডেলা (১৯১৮-২০১৩) |
১৯৪১ সালে, নেলসনের বয়স যখন ২৩, তখনই অভিভাবকদের স্থির করে দেওয়া বিয়ে থেকে পালাতে জোহানেসবার্গে পৌঁছে যান। দু’বছর পর আইনের ডিগ্রি নিতে শ্বেতাঙ্গপ্রধান উইটওয়াটার্সর্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নাম লেখান। দ্রুত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ও জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে তাঁর আলাপ, উদারনৈতিক, বিপ্লবী, আফ্রিকাপন্থী ভাবনা ও ধারণার সঙ্গে বিশেষ করে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (এ এন সি) অন্যতম প্রাণপুরুষ ওয়াল্টার সিসুলু-র সঙ্গে পরিচয় এবং বর্ণবিদ্বেষ ও বৈষম্যের বর্বরতা সম্পর্কে চোখ খুলে যাওয়া। ১৯৪২-এ এ এন সি’তে যোগ দিলেন। পরের বছর প্রথম বিবাহ, সিসুলুর সম্পর্কিত বোন ইভলিন ম্যাসে-র সঙ্গে। ১৫ বছর পরে ১৯৫৭ জানুয়ারিতে চার সন্তান নিয়ে ইভলিন ম্যান্ডেলার বাড়ি ছেড়ে যান।
ইতিমধ্যে নেলসন আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ১৯৫২ সালেই জোহানেসবার্গে তাঁর অংশীদার অলিভার তাম্বোর সঙ্গে যৌথ ভাবে ওকালতিও শুরু করেছেন, বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রচার ও আন্দোলনও। ১৯৫২ সালেই তিনি এ এন সি’র ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হন। সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের উপর শ্বেতাঙ্গ ন্যাশনাল পার্টি সরকারের বঞ্চনা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হন। আর এ জন্য তাঁকে দেশদ্রোহের অপরাধে আরও ১৫৫ জনের সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। চার বছর ধরে বিচার চলার পর অভিযোগ প্রত্যাহৃত হয়। ও দিকে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দেশময় ছড়িয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে ১৯৫৮’য় উইনি মাদিকিজেলার সঙ্গে নেলসনের পরিচয় ও বিবাহ।
২১ মার্চ, ১৯৬০। ট্রান্সভাল প্রদেশের শার্পভিল শহরে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের এক বিক্ষোভ দমন করতে গিয়ে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ গুলি চালিয়ে ৬৯ জনকে হত্যা করে। প্রতিবাদে ফেটে পড়ে দেশ। নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এ এন সি, ম্যান্ডেলা গ্রেফতার হন, ছ’মাস পরে ছাড়াও পান, কিন্তু আন্দোলন ও প্রতিবাদ চলতে থাকে। পরের বছর ম্যান্ডেলা বলেন, আন্দোলনের প্রয়োজনে হিংসার আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে।
১৯৬২, ৫ অগস্ট। নাশকতা ও হিংসার মাধ্যমে সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টার দায়ে অভিযুক্ত ম্যান্ডেলা গ্রেফতার হলেন। অর্থাৎ রাজদ্রোহ। শুরু হল বিচারপর্ব: প্রসিদ্ধ ‘রিভোনিয়া ট্রায়াল’। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা বললেন, ‘আমি এমন একটা গণতন্ত্র ও স্বাধীন সমাজের আদর্শে বিশ্বাস করি, যেখানে সকল মানুষই পারস্পরিক সৌহার্দ্যের সঙ্গে এবং সমান সুযোগ নিয়ে বাঁচবে।... এই আদর্শের জন্য আমি জীবন বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত।’ ১২ জুন, ১৯৬৪। রায় ঘোষণা হল: নেলসন ম্যান্ডেলার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। |
|
শিল্পী: সুমিত্র বসাক। |
১৮ বছর ধরে ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের নিঃসঙ্গ কারাগারে রাখার পরে ১৯৮২ সালে নিয়ে আসা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত পল্সমুর জেলখানায়। ম্যান্ডেলা-সহ এ এন সি-র নেতৃত্ব যখন কারাবন্দি কিংবা স্বেচ্ছানির্বাসনে দেশান্তরী, তখন কৃষ্ণাঙ্গ মহল্লার মানুষরা নিজেদের মতো যথাসাধ্য আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। শত শত কালো মানুষের রক্তে সিক্ত হয়েছে প্রতিটি কৃষ্ণকায় জনপদ। ১৯৮০ সালে নির্বাসিত নেতা বন্ধু অলিভার তাম্বো এক দফা দাবিতে সারা বিশ্ব জুড়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন: ম্যান্ডেলার মুক্তি চাই। ১৯৮৮’তে লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে সমবেত ৭২ হাজার মানুষ ‘ম্যান্ডেলাকে মুক্ত করো’ বৃন্দগান গেয়ে উঠলেন, বিশ্বময় কোটি কোটি মানুষ টেলিভিশনের সামনে তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলালেন। আন্তর্জাতিক চাপ ছিল অনেক আগে থেকেই। অর্থনীতির চাপ। ’৬৭ সাল থেকেই বর্ণবৈষম্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বাঁধন আরও কড়া হয়ে উঠেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রধান রফতানি ‘হিরে’ বয়কট করার আন্দোলন মার্কিন মুলুক সহ গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ল। হাতেনাতে ফলতে লাগল তার ফল। ১৯৯০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট এফ ডব্লিউ ডি-ক্লার্ক এ এন সি-র উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেন। এবং, অবশেষে, সাতাশ বছর বন্দিত্বের পরে ১১ ফেব্রুয়ারি কারাগারের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। শুরু হল তাঁর অভিভাবকত্বে দেশে বহুজাতিক গণতন্ত্র গড়ার প্রক্রিয়া।
সে প্রক্রিয়া কঠিন, বন্ধুর। নতুন গণতান্ত্রিক দক্ষিণ আফ্রিকা গড়ার রুদ্ধশ্বাস তৎপরতায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মেলাতে অহোরাত্র ব্যস্ত ম্যান্ডেলা। শ্বেতাঙ্গ সংস্থাগুলি যাতে দেশ থেকে ব্যবসা গুটিয়ে না নেয়, সে জন্য নিয়মিত বোঝাচ্ছেন। দীর্ঘ অবিচার ও অত্যাচারের প্রতিশোধ বা বদলা যাতে কৃষ্ণাঙ্গরা নিতে উদ্যত না হয়, সে দিকেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি। ১৯৯৩-এর ডিসেম্বরে তাঁকে ও ডি-ক্লার্ককে যুগ্ম ভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হল। পাঁচ মাস পরে, এই প্রথম দক্ষিণ আফ্রিকার সব জাতি, বর্ণ, ধর্ম, সম্প্রদায়ের মানুষ একসঙ্গে এবং অবাধে তাঁদের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ম্যান্ডেলাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করলেন।
ইতিমধ্যে ব্যক্তিগত জীবনেও বড় রকমের পালাবদল ঘটে গেছে। বন্দি ম্যান্ডেলার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনের যিনি ‘মুখ’ হয়ে উঠেছিলেন একদা, কালক্রমে সেই উইনি ম্যান্ডেলার সঙ্গে সম্পর্ক বিষিয়ে গিয়েছিল। ১৯৯২ সালে বিচ্ছেদ। তত দিনে নানা অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের দায়ে উইনি অভিযুক্ত, শেষে গ্রেফতারও।
পাঁচ বছর প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। এই পাঁচ বছরে প্রশাসক হিসেবে অসামান্য দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন, এমন কথা বললে অত্যুক্তি হবে। কিন্তু বহুধাবিভক্ত, বহু দ্বন্দ্বে তাড়িত সমাজ ও রাজনীতিকে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ভারসাম্যে নিয়ে আসার কঠিন কাজটি তিনি যে ভাবে সাধন করেছিলেন, তাকে ঐতিহাসিক বললে কোনও অত্যুক্তি হয় না। প্রতিদ্বন্দ্বী ইনকাথা পার্টির সঙ্গে বোঝাপড়া থেকে শুরু করে এ এন সি’র অন্তর্দ্বন্দ্ব সামলানো সহজ ছিল না। আরও বড় কাজ ছিল বর্ণবৈষম্যের মানসিক উত্তরাধিকার অতিক্রম করে সমাজটাকে মেলানো। ১৯৯৬ সালে তৈরি হল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’, অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক দীর্ণ সমাজের সমে ফেরার নতুন ইতিহাস জন্ম নিল। ১৯৯৫ সালে রাগবি বিশ্বকাপে বিজয়ী স্বদেশের শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়দের অভিনন্দন জানাতে মাঠে হাজির হলেন কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রনায়ক, হয়ে উঠলেন বর্ণবৈষম্য-উত্তর নতুন দক্ষিণ আফ্রিকার অবিস্মরণীয় প্রতীক।
১৯৯৯। দ্বিতীয় নির্বাচন সমাগত। মাডিবা জানালেন: আর নয়। প্রশাসনের দায়িত্ব সহকারী থাবো এম্বেকি-র উপর ন্যস্ত করে তিনি উঠে এলেন বিশ্বমঞ্চে। নানা দেশে সফর, বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে বৈঠক, মানবাধিকার ও অন্যান্য প্রশ্নে প্রচার, বহু সম্মান, এই ধারা অব্যাহত থেকেছে আরও বেশ কিছু কাল। তার পর ২০০৪ সালে জানালেন, এ বার ‘অবসর থেকেও অবসর’। দেশ ও দুনিয়ার উদ্দেশে বললেন, ‘আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন না, আমি আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’ ইতিমধ্যে আশিতম জন্মদিনে তৃতীয় বিবাহ। মোজাম্বিকের প্রসিদ্ধ রাজনীতিক ও মানবাধিকার নেত্রী গ্রাচা মাচেল জীবনসায়াহ্নে তাঁর সঙ্গিনী। নেলসন ম্যান্ডেলা জীবৎকালেই হয়ে উঠেছিলেন এক কিংবদন্তি।
গত প্রায় তিন বছর মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। রবেন দ্বীপের কারাগারে অস্বাস্থ্যকর ১৮টি বছর তাঁকে যক্ষ্মা উপহার দিয়েছিল। পরবর্তী কালে তার সঙ্গে নিউমোনিয়াও যুক্ত হয়। বার বারই তাঁকে ফুসফুসের সংক্রমণ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছিল। গোটা দুনিয়া বেশ কিছু দিন আশঙ্কায় ছিল। |
|
|
|
|
|