তাঁদের সাপ্তাহিক ছুটি নেই। কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা নেই। শ্রমিকের মর্যাদা নেই।
গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীত, ভোরের আলো ফুটলেই হন্তদন্ত হয়ে তাঁদের ট্রেন ধরতে ছুটতে হয়। ঠিক সময়ে বাবুর বাড়িতে পৌঁছতে না পারলে মুখঝামটা বাঁধা। পরে আর পাঁচটা বাড়িতে যেতেও দেরি।
থাকার মধ্যে, গ্রাম-গঞ্জ উজিয়ে শহরে আসার জন্য ছিল ২৫ টাকার ‘ইজ্জত’ মান্থলি। তার জন্য রেল সাংসদ তথা বিডিও/ মহকুমাশাসকদের থেকে আয়ের শংসাপত্র আনার নিয়ম জারি করায় আতান্তরে পড়ে গিয়েছেন পরিচারিকারা। একে তো ওই সমস্ত দফতরে ঢোকাই তাঁদের পক্ষে কঠিন, কাজ আর সংসার সামলে অত সময় বের করাও শক্ত।
প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় জায়গায়-জায়গায় রেললাইনে নেমে পড়ে তাঁরা অবরোধ করেছিলেন। পরে সেই রাস্তা থেকে সরে এলেও কমলি, রাধা, বিশাখারা জানিয়ে দিয়েছেন, লড়াই ছাড়বেন না। আজ, মঙ্গলবার কলকাতার কয়লাঘাটায় রেল দফতরে চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজারের কাছে গণ-ডেপুটেশন দেওয়ার কর্মসূচি নিয়েছে সারা বাংলা পরিচারিকা সমিতি। বিক্ষোভ-মিছিল করার কথাও রয়েছে। সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক লিলি পাল বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়ম শিথিল না হচ্ছে, আন্দোলন চলবে।”
প্রথম দফায় রেলমন্ত্রী থাকার সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিম্ন আয়ের মানুষের কথা ভেবে ১৫ টাকার মাসিক টিকিট চালু করেছিলেন। অপব্যবহারের কারণ দেখিয়ে পরে রেল তা বন্ধ করে দেয়। সে বারও পরিচারিকারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। ২০০১ সালে দ্বিতীয় দফায় রেলমন্ত্রী হয়ে মমতা ফের কম দামের মাসিক টিকিট ‘ইজ্জত’ চালু করেন। তবে ১৫ টাকার সঙ্গে ১০ টাকার সারচার্জ যুক্ত হয়। শ্রমিকের মর্যাদাবিহীন বহু পরিচারিকার কাছেই ওই মান্থলি যেন এক রকম সরকারি স্বীকৃতির সামিল।
কিন্তু সত্যিকারের স্বীকৃতি এবং সুরক্ষা মিলছে কোথায়?
রোজগারের অনিশ্চয়তা তো আছেই। কর্মস্থলে দুর্ব্যবহার, বাড়তি কাজ করিয়ে নেওয়া, বহু ক্ষেত্রে যৌন হেনস্থাও নিয়মিত ঘটে চলেছে। অনেকের স্বামী নেই। কারও স্বামী অসুস্থ বা মদ্যপ। সংসারে টাকা দেন না। অনেক শিক্ষিত মেয়েও পাকেচক্রে পড়ে এই পেশা বেছে নেন। ‘আয়া সেন্টার’ থেকে পাঠানো হলেও বাড়ির সব কাজ করতে হয়। লিলিদেবী জানান, কয়েক বছর আগে সল্টলেকের একটি বাড়িতে পরিচারিকার বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ উঠেছিল। পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। পরে তদন্তে ধরা পড়ে, ওই পরিচারিকার তিন মাসের মাইনে বাকি ছিল। সেই টাকা যাতে না দিতে হয় তার জন্যই চুরির গল্প সাজানো হয়েছিল।
চোরের দায়ে ধরা পড়েছিলেন গীতা নামের এক তরুণীও। তিনি কাজ করতে যেতেন হাওড়ার বেলুড়ে। কাজ ছাড়ার তিন মাস পরে সেই বাড়ির লোকেরা তাঁকে ফের ডেকে পাঠান। বাক্স-সমেত সোনার গয়না চুরির অভিযোগে তাঁকে আটকে রাখা হয়। পরে পুলিশের তদন্তে ধরা পড়ে, বাড়ির লোকই চুরি করেছে। লিলিদেবীর কথায়, “পরিচারিকাদের যন্ত্রণার শেষ নেই। সেই কারণেই একের সমস্যায় অন্যদের পাশে এসে দাঁড়ানোর প্রয়োজন পড়েছে।”
১৯৯৭-৯৮ সাল থেকেই পরিচারিকাদের একাংশ সংগঠিত হতে চাইছিলেন। বছর বারো আগে সংগঠন তৈরি হয়। ইতিমধ্যে হুগলি, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি-সহ সব জেলাতেই শাখা খোলা হয়েছে। প্রধান কার্যালয় কলকাতার লেনিন সরণীতে। সদস্য অন্তত ১৬ হাজার। যদিও তা রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পরিচারিকার সংখ্যার তুলনায় নগণ্য। এসইউসি পিছন থেকে মদত জোগালেও সদস্যেরা জড়ো হচ্ছেন দলমত নির্বিশেষেই। এর মধ্যে অনেকেরই আবার রাজনীতিতে কোনও উৎসাহ নেই। বরং পেশাগত স্বাচ্ছন্দ্যই তাঁদের পাখির চোখ।
পরিচারিকারা আপাতত চাইছেন:
• শ্রমিকের আইনি মর্যাদা।
• সপ্তাহে এক দিন ছুটি। • সরকার বেতন বেঁধে দিক। • অর্থাভাবে যাঁদের সন্তানদের পড়াশোনা থমকে যায়, তাদের পড়ানোর দায়িত্বও নিক সরকার। এই সব নিয়ে ব্লক থেকে রাজ্যস্তর পর্যন্ত মিটিং-মিছিল হচ্ছে। বিগত এবং বর্তমান শ্রমমন্ত্রীর কাছে দাবিদাওয়াও পেশ করা হয়েছে। ২০০১ থেকে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু হয়। বিড়ি শ্রমিক থেকে শুরু করে রাজমিস্ত্রিরা তা পেলেও পরিচারিকারা তালিকায় ছিলেন না। আন্দোলনের জেরেই কয়েক বছর আগে তা সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু পরিচারিকা মাত্রেই কি ধোয়া তুলসীপাতা? অনেকের বিরুদ্ধেই কি দুমদাম কামাই করা, রুক্ষ ব্যবহার, বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগ সঙ্গত নয়? কয়েক মাস আগেই হুগলির শ্রীরামপুর থানার পুলিশ দুই পরিচারিকাকে চুরির অভিযোগে গ্রেফতার করেছিল। পুলিশের দাবি, জেরায় তাঁরা অপরাধের কথা স্বীকারও করেন। এ সব ক্ষেত্রে সংগঠনের ভূমিকা কী? নেত্রীদের দাবি, গুরুতর কোনও অভিযোগ উঠলে এবং তার সারবত্তা থাকলে তা তাঁরা নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন না। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পরিচারিকাকে ডেকে বোঝানো হবে। তাতে কাজ না হলে কোনও বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে সংগঠন তাঁর পাশে থাকবে না।
আপাতত সারা বছর নানা কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের বোঝাপড়া আরও পোক্ত করে তুলতে চাইছে সমিতি। গত বছর ডিসেম্বরে জনাইয়ে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যপরীক্ষা শিবির করা হয়েছিল। শীতে মালিয়ায় পিকনিক করেন শ’দেড়েক মহিলা। মেদিনীপুরের মেয়েরা দিঘায় বেড়াতে যান, কলকাতার মেয়েরা যান বকখালিতে। গত অক্টোবরে হুগলি শাখা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করে। অনেকে গান করে। বাচ্চারা নাচে-আবৃত্তি করে। খাওয়াদাওয়া হয়। ছেলেমেয়েদের বই-খাতাও দেওয়া হয়। সম্প্রতি খানাকুলের এক বিধবা পরিচারিকা মেয়ের ইতিহাসে অনার্স পড়ার খরচ চালাতে পারছিলেন না। সমিতির চেষ্টায় এক তৃণমূল সাংসদ তিন বছরের কলেজের মাইনে এবং হস্টেল ভাড়া দিয়েছেন।
বহু ঘর-গেরস্থালি যাঁদের জিম্মায় থাকে, সমাজে সত্যিকারের ‘ইজ্জত’ পাওয়ার দিকে তাঁরা একটু-একটু করে এগোতে চাইছেন। |