মুর্শিদাবাদের নবগ্রামের পর দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়। জমি নিয়ে অচলাবস্থা কাটাতে পরপর দু’টি ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা নিল রাজ্য সরকার। নবগ্রামে বিদ্যুতের সাবস্টেশন গড়ার জন্য কেন্দ্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনকে জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়ার প্রক্রিয়া আগেই শুরু হয়েছিল। এ বার দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়েও বিদ্যুতের সাবস্টেশন তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণ করে দিচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
ভাঙড়ে ১৮৯৪ সালের কেন্দ্রীয় জমি অধিগ্রহণ আইন মেনেই জমি নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বাজার দরে জমির মূল্য এবং সোলেসিয়াম পাবেন জমির মালিকরা। এ ছাড়া কর্পোরেশন তাঁদের বাড়তি আরও কিছু আর্থিক সাহায্য দিতে রাজি হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের কর্তারা জানাচ্ছেন। সরকারি কর্তাদের দাবি, নতুন করে বাধা না এলে আর তিন মাসের মধ্যেই ১১ একর জমির দখল পেয়ে যাবে ওই বিদ্যুৎ সংস্থা। সোমবার কর্পোরেশনের ডিরেক্টর আর পি শাসমল বলেন, “আশা করছি, তাড়াতাড়িই জমিটি হাতে পাব। জেলাশাসকের কাছ থেকে আমরা সে রকমই প্রতিশ্রুতি পেয়েছি।”
নতুন সরকারের ঘোষিত নীতি হল জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। এমনকী, সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রকল্পের জন্যও জমি অধিগ্রহণ করবে না সরকার। বেশ কিছু ক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাকেও সরাসরি জমি কেনার কথাই বলেছে রাজ্য সরকার। অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে নিজেকে জড়ায়নি। এক কর্তা জানান, বর্ধমানের কাটোয়ায় এনটিপিসি-র তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের অর্ধেক জমি বাম আমলে অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু নতুন সরকার তার নীতি মেনে প্রকল্পের জন্য বাড়তি জমির এক ছটাকও অধিগ্রহণ করে দেয়নি। পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে ডিভিসি-র দ্বিতীয় পর্যায়ের তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজও জমি জটেই আপাতত বন্ধ। যদিও রঘুনাথপুরে ডিভিসি-কে জমি নিতে সাহায্য করছে রাজ্য সরকার। কিন্তু নবগ্রাম এবং ভাঙড়ে সরাসরি জমি অধিগ্রহণের জন্য এগিয়ে আসতে দেখা গেল সরকারকে। অধিগ্রহণ নিয়ে অনীহা পুরোপুরি না কাটলেও উন্নয়নের স্বার্থে নবগ্রাম বা ভাঙড়ে সরকার যে ভাবে সক্রিয় হল, তাতে রুপোলি রেখা দেখছে শিল্প মহল।
ভাঙড়ের আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ পাঠাতে চেয়ে নবগ্রাম ব্লকের দক্ষিণগ্রাম মৌজায় সাবস্টেশন তৈরি করতে চেয়েছিল কর্পোরেশন। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পরে ১৩৪টি পরিবারকে কাছ থেকে ২৯.৫১ একর জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ১০ একর জমি ইতিমধ্যেই রাজ্য কর্পোরেশনের হাতে তুলেও দিয়েছে। বিঘা প্রতি জমির দাম ধার্য হয়েছে ৫ লক্ষ ৯৫ হাজার টাকা। বাড়তি খরচের অংশটি কর্পোরেশন কী ভাবে মেটাবে, তা নিয়ে দিল্লিতে কথাবার্তা চলছে।
আলিপুরদুয়ারেও একটি সাবস্টেশন নির্মাণ করছে পাওয়ার গ্রিড। সেখানে সরকারের সহযোগিতায় জমি কিনে নিয়েছে তারা। এই সাবস্টেশনের মাধ্যমে ভুটান থেকে ভারতে জলবিদ্যুৎ আনার কথা। রায়গঞ্জেও একটি সাবস্টেশন গড়তে আগ্রহী ছিল পাওয়ার গ্রিড। কিন্তু জমি নিয়ে অনেক বেশি জটিলতা থাকায় তারা প্রকল্পটি বিহারে নিয়ে চলে গিয়েছে বলে প্রশাসন সূত্রের খবর। এই সব কিছুর নিরিখে ভাঙড়ের দৃষ্টান্তটি বেশ অন্য রকম বলেই মনে করা হচ্ছে। জমির আয়তন খুব বেশি না হলেও ভাঙড়ে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেকটা দ্রুত সাফল্য পাওয়া গিয়েছে বলে মনে করছে প্রশাসনের একাংশ।
ভাঙড় ২ নম্বর ব্লকের টোনা মৌজায় প্রস্তাবিত সাবস্টেশনটি তৈরি করবে কর্পোরেশন। এ জন্য ১১ একর জমি অধিগ্রহণ করে দিচ্ছে রাজ্য সরকার। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, বেদিক ভিলেজের লাগোয়া ভাঙড় ২ নম্বর ব্লকের মধ্যে পোলেরহাট দু’নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের টোনা মৌজায় ২৫৬টি পরিবারের হাতে জমিটি রয়েছে। এদের মধ্যে ২০-২৫টি পরিবার প্রথম দিকে জমি দিতে আপত্তি করেছিল। সেই সমস্যা মেটায় জমি অধিগ্রহণের নোটিস জারি করে ভূমি দফতর। এই প্রকল্পে সাবস্টেশন নির্মাণের জন্য ৫০০ কোটি টাকা লগ্নি করবে কর্পোরেশন। তৈরি হবে হাজার এমভিএ (মেগা ভোল্ট অ্যাম্পিয়ার) সাবস্টেশন।
কোন পথে জট কাটল?
ভূমি দফতরের এক কর্তা জানান, জমি অধিগ্রহণের জন্য মালিকদের যে দাম দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল সরকার, তার থেকে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি মূল্য দাবি করেছিল পরিবারগুলি। জটিলতার শুরু এই নিয়েই। জট কাটাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে জমি মালিকদের দফায় দফায় বৈঠক হয়। বৈঠকে সরকার ও পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের প্রতিনিধিরাও ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, আইন অনুযায়ী জমির দাম দেবে সরকার। তার বাইরে মালিকদের দাবি মতো পাওনা মেটাবে কর্পোরেশন।
ভূমি দফতরের ওই কর্তা বলেন, “জমি অধিগ্রহণ করে দেওয়া হবে বলে ইতিমধ্যে কর্পোরেশনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে একর পিছু সরকার কী দাম দেবে, তা-ও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।” রাজ্যের ওই চিঠি দেখিয়েই একর পিছু জমির বাড়তি দাম (যা দাবি করেছেন জমির মালিকরা) তাদের পরিচালন পর্ষদের বৈঠকে অনুমোদন করিয়ে নেবে বিদ্যুৎ সংস্থাটি। এবং এটা প্রকল্পেরই ‘বাড়তি খরচ’ বলে ধরা হবে। সরকারি সূত্রের খবর, সাবস্টেশনের জমির জন্য মালিকরা কাঠা পিছু দুই থেকে আড়াই লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ পাবেন। ভাঙড় ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের আরাবুল ইসলাম বলেন, “চাষিদের একশো ভাগ সম্মতি নিয়ে সাবস্টেশনের জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে।”
রাজ্যের বিদ্যুৎ কর্তারা জানাচ্ছেন, পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের সাবস্টেশনের সঙ্গে রাজ্যের গ্রিডের যত বেশি সংযোগ তৈরি হবে ততই পশ্চিমবঙ্গের ভাল। কারণ, এর ফলে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ থাকবে। প্রয়োজন হলে যখন খুশি জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ টানা যাবে। আর তার ফলে অনেক বেশি উন্নত মানের বিদ্যুতও পাওয়া যাবে। ১০০ এমভিএ-র সাবস্টেশনটি তৈরি হলে পশ্চিমবঙ্গ কমপক্ষে ৯০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিড থেকে নিতে পারবে। |