মালদহের জেলাশাসককে গ্রেফতার করে শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনারের পদ হারিয়েছেন দু’দিন আগেই। সোমবার নবান্নে ডিজি-র ঘরে হাজিরা দিয়ে সে জন্য বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু তার পরেও নিজের কাজ নিয়ে তাঁর যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই, তা নবান্নে দাঁড়িয়েই স্পষ্ট ভাষায় বলে গেলেন কে জয়রামন। যদিও এক জন জেলাশাসককে গ্রেফতার করে জয়রামন বিবেচনার কাজ করেননি বলে তাঁদের অবস্থানে অনড় প্রশাসনিক শীর্ষ কর্তারাও। মূলত এই যুক্তিতেই গত শনিবার কিরণকুমারকে গ্রেফতারের পরেই জয়রামনকে পুলিশ কমিশনারের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গেই জানিয়ে দেওয়া হয়, সোমবার ডিজি-র কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। সেই নির্দেশ মেনে এ দিন সকাল সওয়া ১০টা নাগাদ তিনি নবান্নে ঢুকে পড়েন। কিন্তু ডিজি-র ঘরে ডাক পড়ে বেলা ৩টেরও পরে। তার আগে আইজি (আইন-শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা-সহ একাধিক পুলিশ কর্তার সঙ্গে দেখা করেন জয়রামন। প্রায় এক ঘণ্টা ধরে ডিজি-র সঙ্গে কথা বলে হাসিমুখেই বেরিয়ে আসেন তিনি। এর পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জয়রামন বলেন, “এসজেডিএ-র (শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদ) দুর্নীতি মামলা নিয়ে আমার আর কিছু বলার নেই। কারণ, আমি ওই মামলার সঙ্গে এখন আর কোনও ভাবেই যুক্ত নই।” কিন্তু যা ঘটল, তার জন্য কি অনুতাপ হচ্ছে? “কেন?”, পাল্টা প্রশ্ন ওই আইপিএসের। তাঁর মন্তব্য, “আমার কোনও অনুশোচনা নেই। অনুতাপও নেই। সে কথা আমি আগেই জানিয়ে দিয়েছি।” এর পরে কি রাজ্য ছেড়ে কেন্দ্রীয় সরকারি পদে ডেপুটেশনে চলে যাবেন? জয়রামন বলেন, “একেবারেই না। আমি এখানেই থাকব। আজই (সোমবার) তো পুলিশ ডাইরেক্টরেটে কাজে যোগ দিলাম। আপাতত কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে থাকছি।” তাঁর মুখে তখনও হাসির ছোঁয়া। |
জয়রামন নিজের অবস্থানে অনড় থাকায় রাজ্য প্রশাসনের একাংশ যারপরনাই বিব্রত। তবে পদ থেকে সরানো হলেও রাতারাতি তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু করতে নারাজ তাঁরা। সে ক্ষেত্রে আইপিএস মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে বলেই মত ওই প্রশাসনিক কর্তাদের। জয়রামনের বিরুদ্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থা নেবে কি না, তা জানতে চাইলে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্রও এ দিন বলেন, “এখনও তেমন কিছু ভাবা হয়নি।” তবে এখনই যে তাঁকে কোনও দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না, সে ব্যাপারে রাজ্য প্রশাসন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বলেই নবান্ন সূত্রে খবর। তবে তিনি নিজে যে কম্পালসারি ওয়েটিং নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন নন, সে কথা ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়ে দিয়েছেন জয়রামন। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের বক্তব্য, ২০১১ সালে সিবিআই থেকে রাজ্য পুলিশে ফেরার পর তৎকালীন বাম সরকার জয়রামনকে দু’মাস কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে রেখেছিল। ওই মহলেরই দাবি, এ দিন এক ঊর্ধ্বতন কর্তা তাঁকে কিছু দিনের জন্য ছুটিতে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তা কোনও মতেই মানা সম্ভব নয় বলে সাফ জানিয়ে দেন জয়রামন। বরং খুব তাড়াতাড়ি কাজে ফিরবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
সরকারি সূত্রের খবর, দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত জেলাশাসক গোদালা কিরণকুমারকে গ্রেফতারের আর্জি জানিয়ে রাজ্য প্রশাসনকে একাধিক চিঠি লিখেছিলেন জয়রামন। প্রথম দু’টি লিখেছিলেন তৎকালীন ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে, তৃতীয়টি নভেম্বরের শেষে পৌঁছেছিল বর্তমান ডিজি জিএমপি রেড্ডির কাছে। তদন্তে গোদালার বিরুদ্ধে কী ধরনের তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছিল ওই চিঠিতে। পুলিশ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, জয়রামন যেখানে লিখিত ভাবে পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চেয়েছিলেন, সেখানে প্রশাসন কিছুই তাঁকে লিখিত ভাবে জানায়নি।
প্রশাসনিক কর্তারা অবশ্য পাল্টা বলছেন, কিরণকুমার প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান কী, তা জয়রামনকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বক্তব্য, এখানে প্রশ্নটা কোনও ব্যক্তির নয়। তদন্তে কিরণকুমার দোষী প্রমাণিত হলে সরকার তাঁকে আড়াল করবে না। কিন্তু তিনি যত ক্ষণ জেলাশাসক পদে রয়েছেন, তত ক্ষণ সেই পদের মর্যাদা তাঁকে দিতেই হবে। সেই কারণেই জয়রামনকে তাড়াতাড়ি তদন্ত শেষ করে চার্জশিট দিতে বলা হয়েছিল। তার পর যে কিরণকুমারকে তুলনায় কম গুরুত্বপূর্ণ পদে সরিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার অনুমতি দেওয়া হবে, তা-ও জানিয়ে দেওয়া হয় জয়রামনকে। এর পরেও জেলাশাসককে গ্রেফতার করে ওই আইপিএস অফিসার যুক্তিযুক্ত কাজ করেননি বলেই প্রশাসনিক কর্তাদের দাবি। বিশেষ করে ভোটার তালিকা তৈরির কাজ চলার কারণে মালদহ জেলা প্রশাসন যখন নির্বাচন কমিশনের এক্তিয়ারে।
তবে চাকরিজীবনের বহু ক্ষেত্রে স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটা ওই আইপিএস যে বরাবরই কর্তব্যে অবিচল, তা অস্বীকার করেননি কেউই। এমনকী, শাসক-বিরোধী কোনও নেতারই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না বলে জয়রামনের ঘনিষ্ঠ মহলের দাবি। তাঁদের কথায়, “রাজনৈতিক নেতাদের সব কথাই তিনি মন দিয়ে শুনতেন। কিন্তু কখনও চাপের মুখে তদন্তের অভিমুখ বদল করেননি।” জয়রামনের সঙ্গে বেশ ক’বছর কাজ করা একাধিক অফিসারের বক্তব্য, নন্দীগ্রাম নিখোঁজ কাণ্ডে অভিযুক্ত প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠকে যখন মুম্বই থেকে গ্রেফতার করে গভীর রাতে ভবানী ভবনে নিয়ে আসা হয়, তখন অফিসেই ছিলেন তৎকালীন ডিআইজি সিআইডি (অপারেশন) জয়রামন। সে রাতেই চার তলায় লক্ষ্মণবাবুর সামনাসামনি হয়ে হাতজোড় করে বিনীত ভাবে তাঁর কুশল জিজ্ঞাসা করেছিলেন ওই গোয়েন্দা কর্তা। ওই অফিসারদের অভিজ্ঞতা, কাজের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধ হলেও সচরাচর তর্কে জড়িয়ে পড়েননি জয়রামন। তবে নথিতে নিজের মত লিখতে পিছপা হননি কখনওই। কলকাতায় এসে সোমবারও একাধিক বন্ধু, সহকর্মী ও আত্মীয়দের ফোনে একটাই কথা বলছেন আমি আমার ডিউটি করেছি।
এসজেডিএ মামলায় জয়রামন পরবর্তী ঘটনায় রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে নানা মহল। মামলার গোড়া থেকে জনমত অবশ্য রাজ্যের পক্ষেই ছিল। দুর্নীতির খবর পাওয়ার পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দ্রুততায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবকে এফআইআরের অনুমতি দেন, তার পিছনেও সমর্থন আছে আমজনতার। এমনকী, কংগ্রেস ও বামেরা দুর্নীতির মামলা শুরুর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে দোষীদের গ্রেফতারের দাবি তুলেছিল সে সময়। কিন্তু গোদালার গ্রেফতার ও তার জেরে দু’ঘণ্টার মধ্যে জয়রামনকে অপসারণ করায় এসজেডিএ মামলায় সরকারের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠছে। একই সঙ্গে আদালতে প্রথম দিন জেলাশাসকের জামিনের বিরোধিতা করেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরকারি আইনজীবীর অবস্থান বদল নিয়েও প্রশাসনের অন্দরেই সমালোচনা শুরু হয়েছে। মুখ্যসচিবকে এ দিন প্রশ্ন করা হয়, সরকারি আইনজীবী কেন দু’রকম অবস্থান নিলেন? এটা কি অভিযুক্তের প্রতি প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়? মুখ্যসচিবের জবাব, “এটা আপনাদের (সাংবাদিকদের) ব্যাখ্যা।”
শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার ছুটি নেওয়ার পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করলেও আজ, মঙ্গলবার থেকে ১৫ দিনের ছুটিতে যাচ্ছেন মালদহের জেলাশাসক। দুর্নীতি মামলায় গ্রেফতারের পরে এক রাত হাজতে কাটিয়ে রবিবার রাতে তিনি বাড়ি ফেরেন। গ্রেফতারের পরে টানা ৪৮ ঘণ্টা অফিসে যোগ না দিলে চাকরি সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিতে পারত বলে এ দিন কাজে যোগ দেন কিরণকুমার। এর মধ্যেই অবশ্য মালদহের নতুন ডিএম বাছাইয়ের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে রাজ্য প্রশাসন। নবান্ন সূত্রের খবর, কলকাতা পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের অধিকর্তা স্মিতা পাণ্ডে ও শিলিগুড়ি জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদের অতিরিক্ত এগ্জিকিউটিভ অফিসার শরদ দ্বিবেদীর নাম প্রাথমিক বিবেচনার মধ্যে রয়েছে। স্মিতাকে এ দিন নবান্নে ডেকেও পাঠানো হয়। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “যে হেতু মালদহে নির্বাচনের কাজ (ভোটার তালিকা সেংশাধন) চলছে, তাই নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিয়ে জেলাশাসক নিয়োগ করতে হবে।” আজ, মঙ্গলবার সম্ভাব্য জেলাশাসকের তালিকা কমিশনে পাঠানোর কথা সরকারের।
|