দুর্নীতির অভিযোগে জেলাশাসককে লক-আপে ঢুকিয়ে গোটা দেশে হইচই ফেলে দিয়েও মুখে কুলুপ এঁটেছিলেন শনিবার। তাবড় সংবাদমাধ্যম ছেঁকে ধরলেও তাঁর মুখ থেকে বিতর্কিত কোনও মন্তব্য বেরোয়নি। কিন্তু, রবিবার রাজ্য সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে শিলিগুড়ির সেই সদ্য-অপসারিত পুলিশ কমিশনার কে জয়রামন জানিয়ে দিলেন, মালদহের জেলাশাসক গোদালা কিরণকুমারকে গ্রেফতার করে তিনি ভুল করেননি।
সরকারের উঁচু মহলে না-জানিয়ে জেলাশাসককে গ্রেফতার করায় জয়রামনকে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে পাঠানো হয়েছে। যদিও এ দিন শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটের অফিসে বিদায় সংবর্ধনা নেওয়ার পরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে জয়রামন বলেন, “আমি কোনও ভুল কাজ করিনি। আমার কোনও আক্ষেপ বা আফসোসও নেই। যা করেছি ঠিক করেছি। আইন মেনে জনস্বার্থে যা করার করেছি।” |
শিলিগুড়ি কমিশনারেট ছেড়ে চলে যাচ্ছেন জয়রামন। রবিবার ছবি তুলেছেন বিশ্বরূপ বসাক। |
বস্তুত, প্রকাশ্যে এ কথা বলে ওই ডাকাবুকো আইপিএস অফিসার খোদ মুখ্যসচিবের বক্তব্যকেই চ্যালেঞ্জ জানালেন মনে করছেন রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের একাংশ। কারণ, মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র শনিবারই বলেছিলেন, জয়রামন যা করেছেন, তা ঠিক হয়নি। বরং গোটা ঘটনাটি খুবই অস্বস্তিকর।
স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশমহলে এখন প্রশ্ন, জয়রামনের ভবিষ্যৎ কী?
সরকারি সূত্রের খবর, রাজ্য পুলিশের ডিজি জি এম পি রেড্ডির তলব পেয়ে আজ, সোমবারই জয়রামন কলকাতায় আসছেন। কোন পরিস্থিতিতে তিনি মালদহের জেলাশাসককে গ্রেফতার করেছিলেন, পুলিশ প্রধানের কাছে তার ব্যাখ্যা দেবেন। সেই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না-হলে শুধু কম্পালসারি ওয়েটিংয়ে রাখাই নয়, তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হতে পারে বলে পুলিশ অধিকরণ সূত্রে জানা গিয়েছে।
কিন্তু, জয়রামনকে যাঁরা কাছ থেকে দেখেছেন, সেই সব পুলিশ অফিসারদের বক্তব্য, এ সবে বিন্দুমাত্র বিচলিত হওয়ার মতো লোক তিনি নন। অবিচলিত জয়রামনের সাফ কথা, “কলকাতায় যাচ্ছি। নিজের বক্তব্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাব।” এর পরেই তাঁর রসিকতা, “আমি তো সাধারণ ভাবে কোনও জায়গায় ছ’মাস থাকি। এ বার অন্তত সাত মাস থাকলাম! নিজের রেকর্ড ভাঙলাম।”
যে শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেটে সাত মাস থাকলেন জয়রামন, সেখানে একটু অন্য রকম ভাবেই শুরু হয়েছিল রবিবার সকালটা। অন্য দিন সকাল দশটা বা সাড়ে দশটার আগে কমিশনারেটে কর্মব্যস্ততা সাধারণত চোখে পড়ে না। কিন্তু এ দিন সাত সকালেই অফিস সরগরম। এ দিক-ও দিক ছোটাছুটি করছেন সকলে। কনফারেন্স হল সাজানো হয়েছে কিনা, চা-কফির ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে কিনা, তা নিয়ে ব্যস্ত পুলিশকর্মীরা।
কমিশনারেট থেকে ৩-৪ কিলোমিটার দূরেই শালবাড়ির ‘পিনটেল ভিলেজ’। পুলিশ কমিশনারের সরকারি বাংলো। আর পাঁচটা দিনের রুটিনের ব্যতিক্রম এ দিন সেখানেও। খবর কাগজ পড়ার মাঝেই ঘনঘন বাজতে থাকা ফোন ধরা। কিছু সরকারি কাগজপত্র চোখ বুলিয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নিলেন জয়রামন। এরই মধ্যে তাঁকে নিতে চলে এসেছেন এসিপি অভিষেক গুপ্ত। কালো স্করপিও চলল কমিশনারেটের দিকে। সাড়ে ১১টা নাগাদ হাসিমুখে গাড়ি থেকে নেমে জয়রামন এগিয়ে গেলেন কনফারেন্স রুমের দিকে। পরনে গোলাপি ফুলহাতা জামা, কালো প্যান্ট। এমন পোশাকে বহু দিন পরে তাঁকে দেখলেন অধস্তন কর্মী-অফিসারেরা। সেই ‘ট্রেডমার্ক’ ফৌজি মেজাজটাও উধাও।
পুলিশ সূত্রের খবর, সহকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে কনফারেন্স রুমে জয়রামন জানিয়ে দেন, মালদহের জেলাশাসককে গ্রেফতার করে তিনি কোনও অন্যায় করেননি। অনেক পুলিশ অফিসারের মত, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেই ‘সাহেব’ ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তা হলে হয়তো তাঁকে এ ভাবে শিলিগুড়ি ছাড়তে হত না। অফিসারদের অন্য অংশের আবার বক্তব্য, কমিশনার সঠিক কাজই করেছেন। মাথা উঁচু করেই তিনি শিলিগুড়ি থেকে যাচ্ছেন।
ভিতরে যখন অনুষ্ঠান চলছে, বাইরে থাকা কিছু পুলিশকর্মী জানাচ্ছিলেন জয়রামনের অধীনে তাঁদের কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। বলছিলেন, পুজোর রাতে টানা ডিউটি করার ফাঁকে সমস্ত সহকর্মীর জন্য কী ভাবে কন্ট্রোল রুম থেকে আদা চায়ের ব্যবস্থা করেছেন তিনি। উৎসবের মরসুমে সহকর্মীদের রাতের খাবারের বিল মেটানোই হোক বা রোজ রাতে ৩-৪টে অবধি জেগে থেকে প্রত্যেক থানার খোঁজখবর নেওয়া। “ক’জন আইপিএস করেন এমনটা?” বলছিলেন এক পুলিশকর্মী।
আধ ঘণ্টার ছোট্ট অনুষ্ঠান শেষ। কনফারেন্স রুম থেকে বার হতেই সংবাদমাধ্যম ঘিরে ধরল তাঁকে। তাঁদের সামনে রাজ্য ছাড়ার ভাবনাকে সরাসরি না হলেও একটু উস্কে দিয়েছেন জয়রামন। বলেছেন, “আমি বেঙ্গল ক্যাডারের আইপিএস। এ রাজ্যেই কাজ করতে চাই। তবে, কেন্দ্রতেও কাজ করতে হয়। আগেও চেন্নাইয়ে করেছি। দরকার হলে যাব। দেখা যাক কী হয়।” তাঁর সংযোজন, “আমাদের রুটিন বদলি হয়। তবে এ বারের মধ্যে একটি বিষয় জড়িয়ে রয়েছে!”
এর পরেই কিছুটা স্মৃতিমেদুর হয়ে বলেন, “শিলিগুড়ির মানুষকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনেক ভালবাসা পেয়েছি। চাকরি জীবনে আবার সুযোগ পেলে অবশ্যই শিলিগুড়ি আসতে চাই।” পুলিশ অফিসার-কর্মীদের প্রতি তাঁর বার্তা, “আমার আশা, তদন্তকারী অফিসারেরা এসজেডিএ-র দুর্নীতির মামলার কাজ সঠিক ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।”
গাড়িতে উঠতেই পুলিশ লাইনে যে কাণ্ড ঘটল, তা শেষ বার ঘটেছিল ১৮ বছর আগে। ১৯৯৫ সালে দার্জিলিঙের তৎকালীন পুলিশ সুপার অরবিন্দকুমার মালিওয়ালের গাড়ি বিদায়বেলায় রশি দিয়ে বেঁধে টেনে ধরেছিলেন অফিসার, কনস্টেবলেরা। স্থানীয় ভাবে এই প্রথার অর্থ, পছন্দের সাহেবকে যেতে দিতে চাইছেন না পুলিশকর্মীরা। এ দিন একই জিনিস হল। ঘটনার আকস্মিকতায় খানিকটা অপ্রস্তুত জয়রামন দ্রুত অফিসার-কর্মীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রওনা দিলেন পিনটেল ভিলেজের দিকে। বাকি দিনটা কাটল বাংলোতেই। মাঝে দেখা করলেন কয়েক জন অফিসার আর পরিচিতের সঙ্গে। রাতে ট্রেন ধরে রওনা হলেন কলকাতার উদ্দেশে।
নিজের ভবিষ্যৎ জানতে। |