২০০৩-এর মে মাস। পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন। ঘটনাস্থল উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরের কাছে একটি গ্রাম। ব্যারাকপুরের এক সিপিএম নেতার সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েছেন এক আইপিএস অফিসার। মোটা গোঁফ। অনেকটা ফৌজিদের মতো। ওই অফিসারকে ডেকে রীতিমতো ধমকাচ্ছেন সিপিএমের নেতাটি, “এটা উত্তরপ্রদেশ কিংবা বিহার হলে তো আপনি আমাকে সেলাম ঠুকতেন। আর এটা পশ্চিমবঙ্গ বলে উল্টে আমার কথার উপর কথা বলছেন!” ভোটের লাইন সামলাতে গিয়ে কাউকে বুথের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছিলেন না জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওই অফিসার। সিপিএম নেতার রাগটা সেখানেই।
২০১১ সালের মার্চে বিধানসভার নির্বাচনের সময়ে ওই পুলিশ অফিসারকেই দেখা গেল বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন তমলুকের এক সিপিএম নেতার সঙ্গে। নির্বাচনের আগে তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপারের।
তিনি কে জয়রামন, যাঁর সম্পর্কে সমসাময়িক পুলিশ কর্তাদের মন্তব্য, “ও অনেকটা ফৌজিদের মতো। স্রোতে গা ভাসাতে পারে না। যেটা মনে করবে, আইনে যা হবে সেটাই করবে।” |
শিলিগুড়ি পুলিশ কমিশনারেট ছেড়ে বেরিয়ে
আসছেন কে জয়রামন। বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি। |
তাই তাঁর পদক্ষেপ কখনও শাসকদলকে, কখনও প্রশাসনের সর্বোচ্চ মহলকে, আবার কখনও তাঁর নিজের বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্তাদের বিপাকে ফেলে দিয়েছে। সম্প্রতি শিলিগুড়ি পুরসভার দু’টি ওয়ার্ডের উপ-নির্বাচনে বর্তমান শাসকদলের স্থানীয় নেতৃত্বের একাংশও জয়রামনের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলেছিলেন।
জয়রামন সিআইডি-র ডিআইজি (অপারেশনস) থাকাকালীন, ২০১২-র ফেব্রুয়ারি মাসে ১২৫ কোটি টাকার লৌহ আকরিক কেলেঙ্কারির মামলায় গ্রেফতার করা হয় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবরাহ দফতরের প্রাক্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর আইএএস অফিসার দেবাদিত্য চক্রবর্তীকে। কর্মরত হলেও দেবাদিত্যবাবু তখন কম্পালসারি ওয়েটিং-এ ছিলেন। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করায় আইএএস অফিসারদের একাংশ সেই সময় থেকেই জয়রামনের উপর ক্ষুব্ধ ছিলেন বলে তাঁর সহকর্মীদের অনেকেই মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, ২০০৭ সালে কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ এ ব্যাপারে তদন্ত করে দু’জনকে গ্রেফতার করলেও আইএএস অফিসারকে গ্রেফতারের সাহস দেখায়নি।
জয়রামন সিআইডি-তে ডিআইজি (অপারেশনস) হয়ে আসেন রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের অব্যবহিত পরেই। সেই সময়ে সিআইডি-কে হাতে নিতে হয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর দু’টি মামলা বেনাচাপড়ার কঙ্কাল কাণ্ড ও নন্দীগ্রামের নিখোঁজ কাণ্ড। দু’টি মামলার ক্ষেত্রেই তদন্তের সামগ্রিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। বেনাচাপড়ার কঙ্কাল কাণ্ডে গ্রেফতার করা হয়েছিল রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী ও বর্তমানে সিপিএমের বিধায়ক সুশান্ত ঘোষকে। আবার নন্দীগ্রামের নিখোঁজ কাণ্ডে গ্রেফতার করা হয় সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ লক্ষ্মণ শেঠকে।
সিআইডি সূত্রের খবর, কঙ্কাল কাণ্ডে রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রীকে অভিযুক্তদের তালিকায় রাখতে উপর মহল থেকে নির্দেশ এসেছিল। কিন্তু জয়রামন জানিয়ে দেন, ওই নেতার বিরুদ্ধে অপরাধের কোনও প্রমাণ নেই। সিআইডি হেফাজতে সুশান্ত ঘোষ ও লক্ষ্মণ শেঠকে কোনও রকম অসম্মান বা হেনস্থা করারও বিরোধী ছিলেন তিনি। সে জন্য তাঁকে উপর মহলের কাছে জবাবদিহিও করতে হয়েছিল বলে তাঁর সিআইডি-র সহকর্মীরা জানিয়েছেন।
২০১১ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের এসপি হিসেবে অল্প কিছু দিন কাজ করার বছর ছয়েক আগে জয়রামন বাঁকুড়া জেলার এসপি ছিলেন। সেই সময়ে, ২০০৫ সালে বারিকুল থানার ওসি প্রবাল সেনগুপ্ত মাওবাদী নাশকতার শিকার হন। ব্যাগের চেন খুলতে গিয়ে বিস্ফোরণে প্রাণ হারান। বাঁকুড়ায় কাজ করার পর জয়রামন চলে যান সিবিআই-তে। চেন্নাইয়ে সিবিআইয়ের আর্থিক অপরাধ দমন শাখার এসপি হিসেবে তিনি বছর চারেক কাজ করেন। সিবিআই-তে ডেপুটেশনে যাওয়ার আগে অল্প কিছু দিনের জন্য জয়রামন হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার পদেও ছিলেন।
তামিলনাড়ুর বাসিন্দা, ফৌজি অফিসার সুলভ গোঁফ রাখা ১৯৯৭ ব্যাচের এই আইপিএস অফিসার নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার ইঞ্জিন টেকনিশিয়ান হিসেবে। আইপিএস হিসেবে তাঁর প্রথম পোস্টিং উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরের এসডিপিও পদে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে তিনি ব্যারাকপুর ছাড়াও শিলিগুড়ি, কোচবিহার, সল্টলেক ও তমলুকে কাজ করেছেন। ইএফআর-এর কম্যান্ড্যান্ট-ও ছিলেন অল্প কিছু দিন। শিলিগুড়ি কমিশনারেট গঠিত হওয়ার পর সেখানকার দ্বিতীয় কমিশনার হন জয়রামন। তার আগে তিনি ছিলেন দুর্নীতি দমন শাখার ডিআইজি। সেখানেও তাঁর সম্পর্কে ভয় ছিল, হুট করে তিনি কোনও সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেলে দিতে পারেন।
এক আইপিএস অফিসারের কথায়, “কালিয়াপ্পন জয়রামনের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। কিন্তু আমাদের সকলকে একটা ব্যবস্থার মধ্যে থেকে সেই ব্যবস্থাকে কমবেশি মেনে নিয়ে কাজ করতে হয়। জয়রামন সেই ব্যবস্থার তোয়াক্কা করেন না। এটা তাঁর গুণ বললে গুণ, দোষ বললে দোষ।” তাই, নবান্নের নির্দেশ অমান্য করে মালদহের জেলাশাসককে গ্রেফতার করে তিনি যে ভুল করেছেন, সেটাও কিন্তু স্বীকার করে নিচ্ছেন জয়রামনের সঙ্গে কাজ করা আইপিএস অফিসারেরা। |