শেফালি ওরাং। বাঘমুণ্ডির প্রত্যন্ত গ্রাম মুদিডির বাসিন্দা শেফালির স্কুল ছিল বলরামপুর সদরে। ২৫ কিলোমিটার পথ উজিয়ে লালিমতি গার্লস স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন বাস ধরত সে। স্কুলে যাওয়ার পথে এক দিন বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যাওয়ায় তার ডান পা বাদ পড়ে। সেদিন থেকেই শেফালি প্রতিবন্ধী।
পুরুলিয়া শহরের মিঠু নন্দী জন্ম থেকেই মূক ও বধির। বাবা-মাকে হারিয়ে পরিবারে ঠাঁই হয়নি। বরাবাজারের এক প্রত্যন্ত গ্রামের বিচিত্রা মাহাতোর একটি পা ছোট। সেই পায়ের অভিমুখ পিছনের দিকে। আজন্ম এই প্রতিবন্ধী তরুণীর বিয়ে হয়নি। উল্টে পাড়ায় বা গ্রামে অনেকের কটাক্ষ শুনতে হত তাকে। কিংবা বলরামপুরের ঘাটবেড়া-কেরোয়া এলাকার মমতা রুইদাস। উচ্চচায় মেরেকেটে ফুট তিনেক। বিয়ে করে ঘর বাঁধার স্বপ্ন মমতারও অধরাই রয়ে গিয়েছে। |
মমতা, মিঠু, শেফালি বা বিচিত্রারা স্বপ্ন দেখতেই ভুলে গিয়েছিলেন। আজ তাঁদেরও দু’চোখে স্বপ্ন। স্বপ্ন স্বনির্ভর হওয়ার। সমাজে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। কুষ্ঠ ও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা বলরামপুরের একটি সংস্থার ছোঁয়ায় অতীত ভুলে এখন তাঁরা প্রত্যেকেই কাজ পাগল মেয়ে। কেউ মেশিনে সোয়েটার বোনার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, কেউ শিখছেন এমব্রয়ডারির কাজ। কেউ বা চটের ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ নেওয়ার সময় থেকেই সবার নজর কেড়েছে।
বলরামপুরের টাটানগর রোডের উপর সরু একফালি মোরাম বিছানো পথ পেরিয়ে গাছ-গাছালি ঘেরা জায়গায় মমতা, শেফালি, বিচিত্রাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। প্রশিক্ষণ কেন্দ্র না বলে সংসারই বলা যায়। শেফালিদের কথায়, “আমরা এখানকার আবাসিক। বছরখানেক রয়েছি। কেন্দ্রের দাদা-দিদিরাই আমাদের অভিভাবক।” তবে রিতাদির কাছেই তাঁদের সব আব্দার। রিতাদি অর্থাৎ, রিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এই সংস্থার বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষক সংযোজক। কী ভাবে এঁরা পৌঁছলেন এই কেন্দ্রের নাগালে। রিতাদেবীর কথায়, “আমরা কয়েক বছর ধরেই প্রতিবন্ধীদের স্বনির্ভর করার জন্য প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান জেলার একাধিক জায়গায় আমরা শিবির করে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ২০১২ সালের মে মাস থেকে বলরামপুরে আমাদের মূল কেন্দ্রে আবাসিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এমন অনেক প্রতিবন্ধী রয়েছেন, যাঁরা সমাজে অবহেলিত। তাঁদের আবাসিক প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করে তোলার লক্ষ্যেই এই শিবির।”
গাঁধী মেমোরিয়াল লেপ্রোসি ফাউন্ডেশন নামে ওই সংস্থার কর্ণধার সুধাকর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এঁরা এই সময়কালের মধ্যে যে-ভাবে প্রশিক্ষণ রপ্ত করেছে, না দেখলে তা ভাবা যাবে না। এ বার আমরা এঁদের তৈরি জিনিসপত্রের জন্য বাজারের ব্যবস্থা করব। এঁদের তৈরি পাটের ব্যাগ ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে। তা ছাড়া এখনই এঁরা কিছু কিছু জিনিসপত্র তৈরিও করছেন। আমরা কাঁচামাল দিচ্ছি, ওঁরা পারিশ্রমিক পাচ্ছেন। ওই পারিশ্রমিক থেকে তাঁরা সঞ্চয়ও করছেন।”
পাড়া থানা এলাকার শেফালি রায়। এক চোখ নেই বলে সংসারের স্বপ্ন অধরা রয়ে গিয়েছে। এই সংস্থায় কাজ শিখে তাঁর সঞ্চয় এখন কয়েক হাজার টাকা। শেফালির কথায়, “বোনের বিয়েতে আমি দশ হাজার টাকা দিয়েছি। এত ভালো লাগছে, বলার নয়।” বিচিত্রা মাহাতো বললেন, “আমিও কাজ করে পারিশ্রমিকের দশ-পনেরো হাজার টাকা জমিয়েছি।” প্রশিক্ষণ শেষ করা শেফালি ওরাং কাজ পেয়েছিল ঝাড়খণ্ডের একটি প্রতিবন্ধী স্কুলে। তিনি বলেন,“অনেক দূরের স্কুল। যাতায়াতে অসুবিধে হচ্ছিল বলে কাজ ছেড়ে এসেছি। এখন বাড়িতে রয়েছি। কাজের খোঁজ করছি। তবে কোনও সংস্থা যদি একটা সোয়েটার বোনার যন্ত্র কিনে দিয়ে সাহায্য করত, তবে বাড়িতেই কাজ করতে পারতাম।” বিচিত্রার দাদা লক্ষ্মীকান্ত মাহাতো বললেন, “এই সংস্থার জন্য বোন এখন মনে করছে, সে-ও কিছু করতে পারবে। এটাই আমাদের কাছে বড় পাওনা।” |