স্টেফি গ্রাফের বাইশটা গ্র্যান্ড স্ল্যাম তাঁর বাবা পিটার গ্রাফকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছিল, বলতেন স্বয়ং পিটার-ই। সেটার কাছাকাছিই হয়তো পিটার গ্রাফের কাছে থেকে গেল, ক্যান্সারাক্রান্ত পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ শনিবার রাত একটায় মারা যাওয়ার মাত্র দিনকয়েক আগেই বাপ-মেয়ের পুনর্মিলন-চিত্র! গত পনেরো বছরে যা ছিল শুধু বিরলতম নয়, অসম্ভব ফ্রেম!
পিটার গ্রাফ ছিলেন স্টেফির বাবা-কাম-কোচ-কাম-মেন্টর-কাম-ম্যানেজার-কাম কী নয়। তবু এক সময়কার গাড়ি আর বিমা-র সেলসম্যান পিটার গ্রাফ স্টেফির টেনিস-ঐশ্বর্যে নিজেও ক্রোড়পতি হওয়ার পরেও আয়কর-কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে দু’বছরেরও বেশি জেল খাটায় মেয়ে-বাবার সম্পর্ক ভেঙে যায়। এমনকী সাতানব্বইয়ে বাবার হাজতবাস হওয়ার দু’বছরের মধ্যে স্টেফি টেনিস থেকে অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন নিরানব্বই সালে। অথচ সেই সময়েও তাঁর বিশ্ব র্যাঙ্কিং ছিল তিন। তাই নয়, দু’বছর পর ২০০১-এ আন্দ্রে আগাসিকে বিয়ে করে স্টেফি জন্মস্থান পশ্চিম জার্মানির ম্যানহেইম ছেড়ে চিরতরে মার্কিনবাসী হয়ে পড়েন। কিন্তু ইদানীং বাপ-মেয়ের মধ্যে সম্পর্ক ফের স্বাভাবিক হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল। যার পূর্ণাবয়ব ছবিই যেন পিটার গ্রাফ মারা যাওয়ার মাত্র ছ’দিন আগে সেই ম্যানহেইমে-ই বাবার পাশে স্টেফির ফিরে আসা। |
পিটারের মৃত্যুর সময় অবশ্য তাঁর মেয়ে স্টেফি, ছেলে মিখায়েল, প্রথম স্ত্রী হেইদি কেউ ছিলেন না। পরে স্টেফি তাঁর সরকারি ওয়েবসাইটে লেখেন, “আমার প্রিয় বাবা আর আমার সন্তানদের প্রিয় দাদু পিটার গ্রাফ আমাদের ছেড়ে শান্তিলোকে চলে গিয়েছেন। আমরা গভীর শোকাচ্ছন্ন মনে আমাদের একসঙ্গে কাটানোর অসংখ্য সুন্দর মুহূর্তের স্মৃতিরোমন্থন করছি।”
সত্যিই, পিটার-স্টেফির সুন্দর মুহূর্তের যেন শেষ নেই। বিলি জিন কিং যাঁকে নিরানব্বইয়ে “নিশ্চিত ভাবেই সর্বকালের সেরা মেয়ে টেনিস প্লেয়ার” বলেছিলেন, সেই স্টেফিকে মাত্র তিন বছর বয়সে হাতে কাঠের টেনিস র্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছিলেন পিটার। বাড়ির ড্রইংরুমে ছোট নেট লাগিয়ে নিজে এক দিকে দাঁড়াতেন। তিন বছরের স্টেফি থাকত নেটের উল্টো দিকে। যদি এক বার বল নেটের এ দিকে পাঠাতে পারত, পুঁচকে মেয়ের জন্য বাবার পুরস্কার বাঁধা ছিল একটা আইসক্রিম। না হলে ‘পুরস্কার’ ঢুকে যেত রেফ্রিজারেটরে। যে দিন খুদে স্টেফি বল নেট পার করাত, আইসক্রিমও বেরোত ফ্রিজ থেকে। কিন্তু ততক্ষণে সেটা ঠান্ডায় জমে পাথর! স্টেফির চার বছরে তাকে কোর্টে অনুশীলন করানো শুরু করে দিয়েছিলেন পিটার। প্রথম টুর্নামেন্টে নামিয়েছিলেন পাঁচ বছর বয়সেই। নিটফল: তেরো বছরে স্টেফি অনূর্ধ্ব ১৮ ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। চোদ্দো বছরে প্রথম পূর্ণাঙ্গ পেশাদার টেনিস জীবন শুরু করে দেন এবং প্রথম বছরেই (’৮৪) বিশ্ব র্যাঙ্কিং ১২৩। অষ্টআশিতে ‘গোল্ডেন গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ (এক মরসুমে চারটিই গ্র্যান্ড স্ল্যাম আর অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন), কেরিয়ারে ১০৭ খেতাব বা ৮৮শতাংশ ম্যাচ-জয় তো তার পর ইতিহাস। কিন্তু সেই ইতিহাসের বুনিয়াদ তৈরি বাবা পিটার গ্রাফের হাতেই। যিনি স্টেফিকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দেখার জন্য সেই সত্তরের দশকে আস্ত একটা টেনিস হল ভাড়া নিয়েছিলেন। |
তখনও বিচ্ছেদ হয়নি। স্টেফির বাবা-মা পিটার ও হেইদি। |
স্টেফির দেশেরই আরেক টেনিস কিংবদন্তি বরিস বেকার টুইটারে শোকবার্তায় একটাই লাইন লিখেছেন, ‘আরআইপি পিটার গ্রাফ।’ পিটার গ্রাফের শেষযাত্রায় পরিবারেরও যেন সেটাই আর্তি ‘আমাদের পরিবারের মধ্যেই পিটারের শেষকৃত্যের সব কিছু সীমাবদ্ধ রাখার অনুমতি চাইছি সবার কাছে,” স্টেফি গ্রাফের বাবার মৃত্যুর পর এক বিবৃতিতে বলেছেন পিটারের দ্বিতীয় স্ত্রী ব্রিটা। |